স্টাফ রিপোর্টার: ভোররাত। নিঃশব্দ মহাসড়কে ছুটে চলছিলো বাসটি। যাত্রীদের অনেকের চোখেই তখন রাজ্যের ঘুম। দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত শরীরটাকে সিটে এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে ছিলেন সবাই। ভোরের আলোর প্রহর গুনছিলেন কেউ কেউ। হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেট্রোলবোমার আগুনে অঙ্গার হয়ে গেলেন ৭ জন জীবন্ত মানুষ। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাত্রীবাহী ওই নৈশকোচে দুর্বৃত্তদের হামলায় আরও ১৩ যাত্রী গুরুতর দগ্ধ হয়েছেন। লাফিয়ে নামতে গিয়ে আহত হয়েছেন ১৬ জন। এ নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের চলমান অবরোধ ও হরতালে পেট্রোলবোমায় ৩৮ জন নিহত হলেন।
গতকাল মঙ্গলবার ভোররাত সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিয়াবাজারের জগমোহনপুরে নৃশংস ওই ঘটনায় দগ্ধদের ৬ জনকে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। বাকিরাও স্থানীয় হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে নিজস্ব উদ্যোগে ঢাকায় চলে গেছেন। এরমধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রাশেদুল ও শফিকুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের শরীরের ৬৫ থেকে ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে জানান চিকিৎসক।
এ ঘটনায় কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. গোলামুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপর সদস্যরা হচ্ছেন সহকারী পুলিশ সুপার (সদর- এ সার্কেল) জাহাঙ্গীর আলম, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবময় দেওয়ান। রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক এমপিসহ ৱ্যাব-হাইওয়ে ও থানা পুলিশসহ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
পুলিশ, আহত ব্যক্তি ও স্থানীয়রা জানান, সোমবার রাত ৯টার দিকে কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে ‘আইকন’ পরিবহনের বাসটি ছাড়ে। ভোররাত সাড়ে ৩টার দিকে বাসটি জগমোহনপুরে পৌঁছলে দুর্বৃত্তরা বাসটি লক্ষ্য করে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। এতে বাসটির ভেতরে-বাইরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। বাসে ঘুমিয়ে থাকা যাত্রীরা কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই আগুনে পুড়ে ঘটনাস্থলে ৭ জন মারা যান। নিহতরা হলেন- যশোরের গণপূর্ত বিভাগের ঠিকাদার জেলা সদরের ঘোপসেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা হাজী রুকনুজ্জামানের ছেলে নুরুজ্জামান পপলু ও তার একমাত্র মেয়ে যশোর পুলিশ লাইন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণীর ছাত্রী মাইশা নাঈমা তাসনিন, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার আবু তাহের ও আবু ইউসুফ, নরসিংদীর পলাশ উপজেলার আসমা আক্তার ও তার ছেলে শান্ত এবং ঢাকার কাপ্তানবাজারের ওয়াসিম। তাদের দেহ আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। নিহতদের মধ্যে ওয়াসিম ছাড়া বাকি ৬ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। যাত্রীদের আর্তচিৎকারে পুলিশ ও স্থানীয়রা এসে উদ্ধার কাজে অংশ নেয়। খবর পেয়ে চৌদ্দগ্রাম থেকে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
দগ্ধদের মধ্যে ৬ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন- কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার সালেহ আহমেদের ছেলে কাঁচামাল ব্যবসায়ী হানিফ, একই উপজেলার প্রহরচন্দা গ্রামের সৈয়দ আহমেদের ছেলে রাশেদুল ইসলাম বাদশা, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সোনারগাঁ গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে পপকর্ণ বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম, ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামের আমির আলী শিকদারের ছেলে আরিফ শিকদার, একই গ্রামের শরিফুল ইসলামের ছেলে জিলকদ আহমেদ, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার কমলনগর গ্রামের আবদুস সালামের ছেলে ফারুক আহমেদ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ খোন্দকার বলেন, কুমিল্লায় পেট্রলবোমায় দগ্ধ ছয়জন মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে ভর্তি হন। তাদের মধ্যে রাশেদুল ও শফিকুলের অবস্থা আশংকাজনক। তাদের শরীরের ৬৫ থেকে ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। বাকিদের সাত থেকে ১৯ শতাংশ পুড়ে গেছে।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে নিজস্ব উদ্যোগে ঢাকায় চলে গেছেন অন্য দগ্ধরা। তারা হলেন- কক্সবাজারের চকরিয়ার সৈয়দ আহম্মদের ছেলে রাশেদ বাদশা, ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আমির আলীর ছেলে আরিফ শিকদার, মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার কমলনগর গ্রামের ইউনুছ মোল্লার ছেলে শরিফুল ইসলাম, আবুল কালামের ছেলে আলী হোসেন, আবদুস সালামের ছেলে ফারুক আহমদ, নোয়াখালীর মাইজদী উপজেলার আবদুস সালামের ছেলে দুলাল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগঞ্জ এলাকার সালাউদ্দিনের ছেলে শরিফুল ইসলাম। এদের মধ্যে বাদশা ও হানিফের অবস্থা আশংকাজনক।
অপর আহতরা হলেন- যশোরের নিহত নুরুজ্জামানের স্ত্রী মাহফুজা বেগম মিতা, মানিকগঞ্জের আবুল কালামের ছেলে আলী হোসেন, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার কালিরবাজার গ্রামের আলমগীর হোসেনের ছেলে রাতুল, কক্সবাজারের টেকনাফের নুরুল আলমের ছেলে মোহাম্মদ, একই জেলার চকরিয়ার বানিয়াছড়ি গ্রামের নবী মিয়ার ছেলে জমির আলী, পাহাড়িকান্দা গ্রামের সালেহ আহমেদের ছেলে হানিফ, আবদুল লতিফের ছেলে ইমান আলী, আকবর আলীর ছেলে আমির হামজা, আফাজ উদ্দিনের ছেলে বাবু, একই গ্রামের মাইনুদ্দিন, আলাউদ্দিন, গফুরনগর গ্রামের আকবর আলী, হাসনাবাদ গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের ছেলে বাবুল, নরসিংদীর পলাশের জসিম উদ্দিনের ছেলে মুন্নাসহ কমপক্ষে ১৬ জন।
ভয়াবহ এ পেট্রলবোমা হামলার ঘটনায় কুমিল্লা পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী বলেন, দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করতে পুলিশের পাশাপাশি ৱ্যাব-বিজিবির সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত আছে। চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি উত্তম চক্রবর্তী জানান, এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে রেলমন্ত্রী: রেলপথমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপি মো. মুজিবুল হক ঢাকা থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তিনি মিয়াবাজারে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও এলাকাবাসী আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন। এ সময় তিনি খালেদা জিয়ার উদ্দেশে বলেন, খালেদা জিয়া আপনি কেমন করে মানুষ হত্যা করছেন তা দেখে যান। হত্যা-নৈরাজ্য করে দেশকে পাকিস্তান বানাবেন না, নিরীহ মানুষ হত্যা করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখবেন না। বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে ক্ষমতায় যেতে পারবেন না। পরে মন্ত্রী স্থানীয় একটি হোটেলে পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে মন্ত্রী যে কোনো মূল্যে দুর্বৃত্তদের গ্রেফতারে আইনশৃংখলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় হাইওয়ে পুলিশের ডিআইজি মল্লিক ফখরুল ইসলাম পিপিএম, কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল, হাইওয়ে পূর্বাঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম, কুমিল্লা পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী, ৱ্যাব-১১’র উপপরিচালক লে. কমান্ডার গুলজার হোসেন, চৌদ্দগ্রাম থানার ওসি উত্তম চক্রবর্তী। এদিকে এ নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় হাজার হাজার জনতা মহাসড়কে বিক্ষোভ করে।
হতাহতদের সহায়তা: কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের প্রত্যেকের পরিবারকে লাশ পরিবহনের জন্য তাৎক্ষণিক নগদ ১০ হাজার টাকা প্রদান এবং আহতদের জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা সহায়তার ঘোষণা দেন।
হামলাকারীদের ধরিয়ে দিলে পুরস্কার: পেট্রোলবোমা হামলার ঘটনায় জড়িতদের ধরিয়ে দিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। বিকালে কুমিল্লা পুলিশ সুপার (এসপি) টুটুল চক্রবর্তী এ ঘোষণা দেন। তিনি জানান, যারা নাশকতাকারীদের বিষয়ে তথ্য দেবে তাদের পরিচয় গোপন রাখা হবে।