পাওনা টাকা চাওয়ায় চা দোকানি খুন : ছেলেসহ দু সহোদর গুরুতর জখম

মুজিবনগর প্রতিনিধি: ধার দেয়া মাত্র ৪শ টাকা ফেরত চাওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিরোধের জের ধরে এক পক্ষের নগ্ন হামলায় নিহত হয়েছেন চা বিক্রেতা লিয়াকত শেখ (৫০)। প্রতিপক্ষের ধারালো অস্ত্রের উপুর্যপরি কোপে লিয়াকত আলীর ছেলে ও আপন দুই ভাই গুরুতর আহত হয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল শুক্রবার বিকেলে মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান বাজারে লিয়াকত আলীর চায়ের দোকানের সামনে। এ ঘটনায় নিহতের পরিবার ও গ্রামজুড়ে বইছে শোকের ছায়া। তুচ্ছ ঘটনার নগ্ন বহির্প্রকাশে খুনের ঘটনায় এলাকাজুড়ে বইছে নিন্দার ঝড়।
লিয়াকত শেখ বাগোয়ান গ্রামের গোলাম মক্করের ছেলে। লিয়াকত আলীর ছেলে আহত ফয়সাল হোসেন (২৫), ভাই মাবুদ শেখ (৪৫) ও পারভেজ হোসেনকে (৪০) গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয় ও আহতসূত্রে জানা গেছে, বাগোয়ান গ্রামের মৃত আবু লাইচ খাঁ’র ছেলে জামাত আলী ওরফে খোকার কাছে ৪শ টাকা ধার দিয়েছিলেন চা দোকানি লিয়াকত আলীর ভাই রিপন মিয়া। টাকা নেয়ার বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেলেও টাকা পরিশোধ করছিলেন না খোকা। গতকাল শুক্রবার জুম্মার নামাজের খুতবা পাঠের সময় খোকার চাচাতো ভাইয়ের শিশুপুত্র হেসে ওঠে। নামাজের পর তার প্রতিবাদ করেন রিপন হোসেন। এ নিয়ে রিপন ও খোকার পরিবারের লোকজনের মধ্যে মৃদু উত্তেজনা দেখা দেয়। এ সময় অন্যান্য মুসল্লিদের মধ্যস্থতায় বিষয়টি মীমাংসা হয়। ভাল মনেই উভয় পক্ষের লোকজন বাড়ি ফিরে যায় বলে জানান কয়েক মুসল্লি।
স্থানীয়সূত্রে আরো জানা গেছে, মসজিদের উত্তেজনার জের সাময়িকভাবে নিরসন হলেও রিপনের মনের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকে। বিকেলে বাগোয়ান বাজারে অবস্থিত লিয়াকত শেখের চায়ের দোকানে চা পান করতে আসেন জামাত আলী ওরফে খোকা। তাকে দেখে রিপনের ভেতরে চাপা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটে। রিপন হোসেন তার পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য খোকাকে চাপ দেয়। এতে রিপন ও খোকার মধ্যে বাগবিতণ্ডা শুরু হয়। চরম উত্তেজিত অবস্থায় দুজনের মধ্যে হাতাহাতি অবস্থার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে রিপন হোসেন ও তার ভাই মিলে কয়েকটি কিল-ঘুষি দেয় খোকাকে।
বাগোয়ান বাজারের পাশেই লিয়াকত শেখ ও খোকা মিয়ার বাড়ি। তারা দুজন দুজনের প্রতিবেশী। রিপন ও তার লোকজন জামাত আলী ওরফে খোকাকে মারধর করলেও একা খোকা প্রতিবাদ করতে পারছিলেন না। মারধরের খবর পেয়ে খোকার ভাই জিয়ারত আলী ওরফে খোকন, চাচাতো ভাই মশিউর রহমান, ওবিদুল ইসলাম, কাবিদুল ইসলাম, লিয়াকত আলী, হায়াত আলী, দুদু ভরসাসহ পরিবারের কয়েকজন একত্রিত হয়ে রিপনের লোকজনকে ধাওয়া করে। তারা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রিপনের লোকজনের ওপর হামলা চালায়। ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে লিয়াকতের দোকানে। ভয়ে দৌঁড়ে পালিয়ে যায় রিপন। তবে রিপনের ভাই লিয়াকত ও তার ছেলে এবং অপর দু ভাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করে খোকার পরিবারের লোকজন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো জানায়, বাজারের উপস্থিত মানুষের কিছু বুঝে ওঠার আগেই ৫/৭ মিনিটের মধ্যে গণ্ডগোল শেষ হয়। খোকার পরিবারের লোকজন পালিয়ে গেলে স্থানীয়রা আহত চারজনকে মুজিবনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। এ সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক লিয়াকতকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসাধীন রাখা হয় আহত বাকি তিনজনকে।
বাগোয়ান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠের পাশে রাস্তার ধারে গড়ে উঠেছে বাজার। ওই বাজারের পাশেই নিহত লিয়াকত ও খোকার বাড়ি। গতকাল ছিলো সাপ্তাহিক হাটের দিন। তাই স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতা-বিক্রেতারা ছিলেন বেচাকেনায় ব্যস্ত। এর মধ্যে প্রকাশ্য দিবালোকে এ ধরনের হামলার ঘটনায় উপস্থিত সকলেই যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। রক্ত দেখে শিউরে ওঠেন প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই। হামলাকারীরা পালিয়ে গেলে প্রত্যক্ষদর্শীরা আহতরদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করেন।
এদিকে খবর পেয়ে ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ। শুরু হয় গ্রেফতার অভিযান। তবে গতরাত সাড়ে ১১টার দিকে এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
মুজিবনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজী কামাল হোসেন জানান, লিয়াকতের লাশের ময়নাতদন্তের জন্য আজ শনিবার সকালে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালমর্গে লাশ প্রেরণ করা হবে। হাসপাতাল থেকেই লাশ নেয়া হয়েছে পুলিশ হেফাজতে। ঘটনার পর থেকেই হামলাকারীদের ধরতে অভিযান শুরু হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে আসামিদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে আশার কথা শোনান তিনি। বর্তমানে গ্রামের পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
নিহতের পারিবারিক পরিচয়: বাগোয়ান গ্রামের গোলাম মক্করের ৯ ছেলে ও ৫ মেয়ের মধ্যে নিহত লিয়াকত ৬ষ্ঠ। নিহত লিয়াকত শেখের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে ফয়সাল আহম্মেদ উন্মুক্ত বিশ^বিদ্যালয়ের এইচএসসির ছাত্র এবং মেয়ে কেয়া খাতুন বাগোয়ান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী। বাগোয়ান বাজারে চা দোকানীর পাশাপাশি স্বল্প পরিসরে চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন তিনি। পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে তাইতো ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী বাকরুদ্ধ। পরিবারে চলছে শোকের মাতম। এলাকায় বিরাজ করছে শোকের ছায়া।

Leave a comment