আনোয়ারের কুষ্টিয়া পৌর ঝণ্টুর দামুড়হুদার উজিরপুর ও হবির মিরপুর নওদাপাড়া গোরস্থানে ঠাঁই

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পরে তিন জনের মরদেহ পৃথক স্থানে দাফন
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদের) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জাতীয় নেতা কাজী আরেফ আহমেদসহ ৫ জাসদ নেতা হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে। তিন আসামির দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার ভোরে কুষ্টিয়ার পৌর গোরস্থানে আনোয়ার হোসেনেকে, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার উজিরপুরের রিয়াজুল জান্নাহ করবস্থানে রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু ও কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মালিহাদ ইউনিয়নের রাজনগর গ্রামের কামার নওদাপাড়া গোরস্থানে সাফায়েত হোসেন হাবিবকে দাফন করা হয়। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১১টা ০১ মিনিট থেকে ১১টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩ আসামির ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। পরে ওই রাতেই মৃতদেহ পৌঁছায় নিজ নিজ স্বজনদের কাছে।
আনোয়ার হোসেনের নিজ গ্রাম মিরপুর উপজেলার কুর্শায় কোনো আত্মীয়-স্বজন না থাকায় ভোররাতে তার লাশ দাফন হয় কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থানে। শুক্রবার ভোররাতে আনোয়ার হোসেনের মরদেহ পুলিশি পাহারায় অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়। গোরখোদকরা জানান, ১০-১২ জন আত্মীয়স্বজন ও কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের উপস্থিতিতে লাশ দাফন সম্পন্ন হয়।
এদিকে কুষ্টিয়ার নিজ গ্রামে রাশেদুল ইসলাম ঝন্টুর কেউ না থাকায় চুয়াডাঙ্গার উজিরপুর গ্রামে তার বোনের বাড়িতে তার লাশ দাফন করা হয়। রাশেদুল ইসলাম ঝন্টুর লাশ চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার উজিরপুরে দাফন করা হয়েছে। শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে উজিরপুর গ্রামের রিয়াজুল জান্নাহ করবস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে উজিরপুর বায়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে স্থানীয় কাসেমুল উলুম মাদরাসার কারী আব্দুর রহমান জানাজা পড়ান।
রাত ৩টা ২৫ মিনিটে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে পুলিশ প্রহরায় ঝন্টুর লাশ উজিরপুর গ্রামে নিয়ে আসা হয়। তার লাশ গ্রহণ করেন বড় ভাই মন্টু ও ভাগ্নে লিটন।
দামুড়হুদা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লিয়াকত হোসেন জানান, কুষ্টিয়ার নিজ গ্রামে ঝন্টুর কেউ না থাকায় চুয়াডাঙ্গার উজিরপুর গ্রামে তার বোনের বাড়িতে তার লাশ দাফন করা হয়।
অপরদিকে শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে সাফায়েত হোসেন হাবিবকে তার নিজ গ্রাম মিরপুর উপজেলার রাজনগর এলাকার কামার নওদাপাড়া গোরস্থানে দাফন করা হয়। কাকিলাদহ ক্যাম্প ইনচার্জ জালাল উদ্দিন খাঁন জানান, ভোরে লাশ তার গ্রমের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। পরে সকাল ৯টায় রাজনগর এলাকার কামার নওদাপাড়া গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। এ মামলার অন্যতম সাক্ষী হন কারশেদ আলম জানান, রায় কার্যকর হওয়ায় আমরা আনন্দিত। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরে শেষ পর্যন্ত আদালতের রায় কার্যকর হয়েছে। বছরের পর বছর অপেক্ষা করে ছিলাম এ রকম একটি দিনের জন্য। আমি দেখেছি কি নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো তাদের। এ হত্যাকারীদের ফাসির রায় কার্যকরের মধ্যদিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটতে কাজী আরেফ আহমেদ তার জীবদ্দশায় শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত যে লড়াই করে গেছেন যে আদর্শিক চেতনায় তিনি একটা সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখার অপরাধে সন্ত্রাসীদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়মাঠে সন্ত্রাস বিরোধী এক জনসভায় জাসদ কেন্দ্রীয় সভাপতি জাতীয় নেতা কাজী আরেফ আহমেদ, জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী, স্থানীয় জাসদ নেতা ইসরাইল হোসেন ও শমসের মণ্ডল একদল সন্ত্রাসীর গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ঘটনার দিনই পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি পরদিন সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের সাড়ে পাঁচ বছর পর ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট কুষ্টিয়ার জেলা ও দায়রা জজ আদালত ১০ আসামির ফাঁসি ও ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করলে ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ নিম্ন আদালতের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১০ আসামির মধ্যে ৯ জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন। অপর আসামি এলাজ উদ্দিন হাইকোর্টে মামলা চলাকালে মৃত্যুবরণ করেন। একই সাথে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির সাজা মওকুফ করেন মহামান্য হাইকোর্ট। এরপর হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ফাঁসির তিন আসামি রাশেদুল ইসলাম ঝন্টু, আনোয়ার হোসেন ও হাবিবুর রহমান হাবি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। ২০১১ সালের ৭ আগস্ট প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি শেষে আপিলকারী ফাঁসির ৩ আসামিসহ ৯ জনের সাজা বহাল রাখেন।
দামুড়হুদা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩ আসামির মধ্যে ঝন্টুর মৃতদেহ চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার উজিরপুর গ্রামের কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে জানাজা শেষে উজিরপুর গ্রামের কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ঝন্টুর চাচাতো ভাই অবসরপ্রাপ্ত বিডিআর আবুল কাশেম জানান, পরিবারের পক্ষ থেকে আমি ৩/৪ প্রতিবেশীকে সাথে নিয়ে যশোর থেকে লাশ আনতে যাই। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত ঠিক ১টা ১৮ মিনিটে ঝন্টুর লাশ আমার কাছে হস্তান্তর করে। পুলিশ পাহারায় ভোর ৩টা ৫০ মিনিটে ঝন্টুর লাশ নিয়ে আমরা উজিরপুরে পৌঁছাই।
ঝন্টুর সংক্ষিপ্ত পরিচয়: ২ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে রাসেদুল ইসলাম ঝন্টু ছিলো সকলের ছোট। বড় ভাই মন্টু ঢাকায় একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। একমাত্র বোন ফাতেমা খাতুনের বিয়ে হয়েছে দামুড়হুদার উজিরপুরের মোয়াজ্জেম মণ্ডলের সাথে। ঝন্টুর দাদারা ছিলেন ৩ ভাই। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির সময় ভারতের কৃষ্ণনগর থেকে জমিজমা বিনিময় করে বাংলাদেশে চলে আসেন। ৩ জনের মধ্যে ঝন্টুর দাদাসহ দুভাই জমির ভাগ পান কুষ্টিয়ার কুরশা গ্রামে। বিনিময় সূত্রে পাওয়া ঝন্টুর আরেক দাদা জমির ভাগ পান দামুড়হুদার উজিরপুরে। ঝন্টুর বয়স যখন ৮ কি ৯ বছর ওই সময় তার পিতা আবুল হোসেন মারা যান। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ইতি হয় লেখাপড়ার। ৮ বছর আগে ঝন্টুর মা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শেষমেষ একমাত্র বোন ফাতেমার ঠিকানায় তার লাশ পাঠানোর ব্যবস্থা হয়। ব্যক্তিগত জীবনে ঝন্টু ছিলো অবিবাহিত।