স্টাফ রিপোর্টার: বেসরকারি মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন ও এর শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ৬৯১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আদালতে নালিশি মামলা করেছেন প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের পাঁচ কর্মচারী। রোববার ঢাকা মহানগর হাকিম ইউসুফ হোসেনের আদালতে মামলার আবেদন করা হলে আদালত তা আমলে নেন। একই সাথে ভাটারা থানা পুলিশকে মামলা তদন্ত করার নির্দেশ দেন আদালত।
মামলার আসামিরা হলেন- গ্রামীণফোন লিমিটেড, গ্রামীণফোন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সিইও রাজিব শেঠী, গ্রামীণফোন ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান (তৎকালীন) কাজী মোহাম্মদ শাহেদ (বর্তমানে টেলিনর ইন্ডিয়ার মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক), সদস্য মো. মাইনুর রহমান ভূঁইয়া, মো. মঈনুল কাদের ও আহমেদ মনজুর উদদৌলা। বাদীরা হলেন- গ্রামীণফোন লিমিটেডের পরিবহন শ্রমিক নেতা মেহেদী হাসান, মাসুদ হাসান, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. সোহাগ, অফিস সহকারী আফজাল হোসেন ও অপটিক্যাল ফাইবার অপারেটর নিজাম উদ্দিন পাটোয়ারী। এর মধ্যে মেহেদী হাসান আদালতে পাঁচজনের পক্ষে জবানবন্দি দেন।
মামলার আবেদনে বলা হয়, বিবাদীরা গ্রামীণফোন ওয়ার্কার্স প্রফিট ফান্ড অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার ফান্ডের ১৩শ কর্মচারীর প্রায় ৭শ কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। পাওনা টাকার জন্য আবেদন করলে তাদের বিভিন্নভাবে অপমান ও অপদস্ত করা হয়। তাই তারা আদালতের কাছে ন্যায়বিচারের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। আবেদনে আরও বলা হয়, ২০১০ সালে সরকার কোম্পানির লাভের ৫ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের ঘোষণা দেয়। ২০১৩ সালের ২৪ অক্টোবর গ্রামীণফোন লিমিটেডের পরিচালক সভায় তা পাস করা হয়। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে বিবাদীরা শ্রমিকদের টাকা না দিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। শ্রম আইন অনুযায়ী, একশর বেশি কর্মী সংখ্যার কোনো কোম্পানির হিসাব বছরের শেষদিনে পরিশোধিত মূলধন এক কোটি টাকা এবং স্থায়ী সম্পদ দু কোটি টাকা হলে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল কিংবা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে বার্ষিক লভ্যাংশের ৫ শতাংশ জমা দিতে হয়। আইন অনুসারে, প্রত্যেক বছর অংশগ্রহণ তহবিলে জমাকৃত মোট অর্থের দু-তৃতীয়াংশ সমান অনুপাতে সব সুবিধাভোগীদের মধ্যে নগদে বণ্টন করা হবে এবং এক-তৃতীয়াংশ বিধি মোতাবেক বিনিয়োগ করা হবে, যার মুনাফা সুবিধাভোগীদের মধ্যে সমান অনুপাতে বণ্টন হবে।
মামলা প্রসঙ্গে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ জানায়, আদালতের কোনো আদেশ বা নোটিশ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তারা পায়নি। তাই এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।
মামলার বাদী মেহেদী হাসান গতকাল রোববার বলেন, শ্রমিকদের প্রায় ৭শ কোটি টাকার ডব্লিউপিপি ফান্ডের অর্থ গ্রামীণফোনের কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন। আমরা এ নিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন করলে নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়। আমাদের অনেকেরই এখন ইনক্রিমেন্ট ও বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। আতংকে দিন কাটছে। তিনি বলেন, ২ বছরের বেশি সময় ধরে ইউনিয়ন কার্যক্রম স্থগিত করে রাখা হয়েছে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ দিয়ে। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানালেও আমাদের আবেদনের শুনানি হচ্ছে না। তার মতে, এক তহবিলের অর্থ অন্য তহবিলে অবৈধভাবে স্থানান্তর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ। বিদ্যমান আইনে বিষয়টি দুদক দিয়ে তদন্ত করারও দাবি জানান তিনি।
মেহেদী বলেন, ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গ্রামীণফোনের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ হিসাবে ৪ বছরে ৬৯৭ কোটি ৩৫ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯ টাকা রিজার্ভ থাকার কথা। এর মধ্যে বোর্ড অব ট্রাস্টি যে ৬৯১ কোটি ৩৮ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৩ টাকা বুঝে পেয়েছে। এ টাকা এফ ক্যাটাগরির ১৩ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীরা পাননি। ভাগাভাগি হয় গ্রামীণ ফোনের এ থেকে ই ক্যাটাগরির ৩ হাজার ৪০৭ কর্মকর্তার মধ্যে। এ ভাগবাটোয়ারার নেতৃত্বে ছিলেন গ্রামীণফোনের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা ও বোর্ড অব মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক, কাজী মোহাম্মদ শাহেদ (বর্তমানে টেলিনর ইন্ডিয়ার মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক), সদস্য মো. মাইনুর রহমান ভূঁইয়া, মো. মঈনুল কাদের ও আহমেদ মনজুর উদদৌলা।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা আন্দোলনে নামলে অর্থ আত্মসাৎকারী কর্মকর্তারা তাদের ওপর নির্যাতন-হয়রানি শুরু করেন বলে জানান মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, অনেককে চাকরি পর্যন্ত হারাতে হয় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায়। চলতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি বঞ্চিত কর্মচারীরা গ্রামীণফোন প্রধান কার্যালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট পালন করতে চাইলে র্যাব তাদের ওপর ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। এ ঘটনায় অনেক শ্রমিক আহত হন।
একইভাবে ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে গত মাসে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে মামলা করেন প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের (রেজি নং-বি ২১৬১) সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান। এ মামলায় ঢাকার প্রথম শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান তাবাসসুম ইসলাম পাঁচজনের কাছে লিখিত জবাব চেয়ে নোটিশ জারি করেন। ওই পাঁচজন হলেন- রাজিব শেঠী, কাজী মোহাম্মদ শাহেদ, মো. মাইনুর রহমান ভূঁইয়া, মো. মঈনুল কাদের ও আহমেদ মনজুর উদদৌলা। ২ নভেম্বর তারা অভিযোগের বিষয়ে জবাব এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আদালতে দাখিল করেন। আদালত তাদের মঙ্গলবার সশরীরে অথবা প্রতিনিধির মাধ্যমে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছেন।