নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে বিপাকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি

স্টাফ রিপোর্টার: স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হক নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চাকরি দেয়ার শর্তে নিজ এলাকায় এসব নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন। তার এসব অনৈতিক কাজের অন্যতম সহযোগী তারই ভাতিজা মো. রফিকুল ইসলাম টিটু।

সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নূরুল হকের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার হোসেনদী ইউনিয়নে। তার ভাতিজা মো. রফিকুল ইসলাম টিটু থাকেন কিশোরগঞ্জ শহরে। চাচা মহাপরিচালক হওয়ার সুবাদে ভাতিজা কিশোরগঞ্জে বিকল্প ডিজি অফিস গড়ে তোলেন। যেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়োগ, বদলি, পদায়ন।

স্থানীয় ভুক্তভোগীরা জানান, ডা. দীন মো. নূরুল হক ডিজি হওয়ার পর থেকে ভাতিজা টিটু এ পর্যন্ত স্বাস্থ্য সহকারী, অফিস সহায়ক, ওয়ার্ডবয়, নিরাপত্তা প্রহরী, আয়া, কুক, মশালচী, জুনিয়র মেকানিক, স্টোরকিপার, পরিসংখ্যানবিদ ও সুইপার পদে নিয়োগের নামে ১৫৮ জনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ১৩৫ জনের নিয়োগ নিশ্চিত হয়েছে। বাকি ২৩ জনের নিয়োগ স্থগিত রয়েছে। চাকরির পদভেদে জনপ্রতি ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে নেয়া হয়েছে। তারা জানান, মহাপরিচালকের ভাতিজা মো. রফিকুল ইসলাম টিটু কিশোরগঞ্জ শহরের খরমপট্টির মেসার্স রাইসা মেডিকেল সেন্টারের মালিক। তিনি সেখানে বসে তার নিয়োজিত দালালদের মাধ্যমে প্রায় কয়েক হাজার চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন। এরপর যারা অগ্রিম টাকা দিতে পেরেছেন তাদের চাকরি নিশ্চিত করেন। এসব প্রার্থীর চাকরি নিশ্চিত করতে চাচার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার সাবেক সিভিল সার্জন মৃণাল কান্তি পণ্ডিতসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যবহার করেছেন। তিনি ডিজির ভাতিজা হওয়ায় স্থানীয় কেউ তার ওপর কথা বলার সাহস পান না। এলাকাবাসী জানিয়েছে, ভাতিজার তদবির করে দেয়ার জন্য স্থানীয় কর্মকর্তাদের ওপর অলিখিত নির্দেশনা থাকায় নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা নিয়মনীতিকে আমলে নেননি।

জানা গেছে, ক্ষমতাবান চাচার সহযোগিতায় ১৫৮ জনের নিয়োগ প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করেন টিটু। এসব নিশ্চিত করতে গিয়ে চাকরির সাধারণ অনেক শর্তসহ অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটাও লংঘিত হয়েছে। এমনকি সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের এলাকা ইটনা, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর, ভৈরবের কোনো প্রার্থীকে চাকরি দেননি এই ডিজি। তবে সরকারি দলের স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী লোকের কারণে টিটুর লম্বা তদবির তালিকা থেকে ২৩ জন ছিটকে পড়ে।

এদিকে টাকা দিয়েও চাকরি না হওয়ায় এসব প্রার্থীর মধ্যে ১৮ জন পৃথকভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। বাকিরা ভাতিজা টিটুর ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।

রুবিনা সুলতানা নামে ভুক্তভোগী এক প্রার্থী স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে গত ১১ অক্টোবর লিখিত অভিযোগ দেন। এতে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগের জন্য গত বছর ২৪ জুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। এরপর তিনি যথাযথভাবে চাকরির জন্য আবেদন করেন। একপর্যায়ে তিনি জানতে পারেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজির ভাতিজা টিটু সাহেবকে টাকা না দিলে চাকরি পাওয়া যাবে না। এমতাবস্থায় ঘুষের বিনিময়ে চাকরি পাওয়ার পূর্ণ নিশ্চয়তা পাওয়ায় তিনি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের ভাতিজা মো. রফিকুল ইসলাম টিটুকে নগদ ৬ লাখ টাকা ঘুষ দেন। কিন্তু লিখিত পরীক্ষা শেষে মৌখিক পরীক্ষা দিতে পারলেও তিনি চাকরি পাননি। এ অবস্থায় ঘুষের টাকা ফেরত চাইলে টিটু অশালীন গালাগাল করেন। চাচার ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চাঁদাবাজির মামলায় জেলে ঢোকানোর ভয়ও দেখান। চাকরি প্রার্থী রুবিনা তার অভিযোগে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে তার টাকা উদ্ধারসহ অভিযুক্তদের শাস্তি এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে একই ধরনের অভিযোগ করেন কটিয়াদীর হুমায়ুন, আল মামুন, মিঠামইনের মো. মুসলেহ উদ্দিন, কুলিয়ারচরের রুবিয়া আক্তার, ভৈরবের মাহমুদা আক্তার নূপুর, মো. আমিনুল ইসলাম, নয়ন মনি সাহাসহ ১৭ জন।

অভিযোগকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চাচার মাধ্যমে চাকরির নিশ্চয়তা দিয়ে টিটু কারও কাছ থেকে ৬ লাখ, কারও কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। পাশাপাশি এই ঘুষের কথা কেউ যেন জানতে না পারে সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেন। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও চাকরি দিতে পারেননি। এ পর্যায়ে তার কাছে টাকা ফেরত চাইলে তিনি নানা হুমকি দিচ্ছেন। মারমুখী আচরণ করছেন। এমনকি কয়েকজনকে লাঞ্ছিত করতে পিছপা হননি। আবার কাউকে ধমক দিয়ে সাফ বলে দেন, ‘যা ঢাকায় গিয়ে ডিজির কাছ থেকে টাকা নিয়ে আয়।’ ভুক্তভোগীরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে নিয়োগ নিয়ে এহেন ঘুষ বাণিজ্য ও প্রতারণা করার জন্য অধিদফতরের ডিজি ও তার ভাতিজার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।

এসব অভিযোগের বিষয়ে মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হকের গ্রামের বাড়ি হোসেনদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল মিয়ার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, চাকরি দেয়ার নামে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চাকরি দিতে না পারাসহ হয়রানি করার বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।