হার্ডলাইনে নওয়াজ : ফের ফৌজি শাসনেরপথে পাকিস্তান

মাথাভাঙ্গা মনিটর: ফের ফৌজি শাসনের পথে হাঁটছে পাকিস্তান। গতকালপ্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফের মধ্যে টানা ২ঘণ্টার বৈঠক তারই ইঙ্গিত দিয়েছে। বৈঠকে নওয়াজকে এক মাসের জন্য পদত্যাগ করাসহ বেশ কিছু উপায় বাৎলে দিলেন জেনারেল রাহিল শরিফ। নওয়াজ পদত্যাগ করলে একমাসের মধ্যে গত বছরের নির্বাচন নিয়ে যে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে তা তদন্ত করাহবে। তবে সেনাপ্রধানকে নওয়াজ জানিয়ে দিলেন, তিনি পদত্যাগ করবেন না। একটিবেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল খবর দিয়েছে, বৈঠকে নওয়াজ শরিফকে সেনাপ্রধানপদত্যাগ করতে অনুরোধ করেছেন। তবে এ রিপোর্ট প্রচার হওয়ার পর পরই আইএসপিআরথেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, এমন খবর ভিত্তিহীন।প্রেসিডেন্ট মামনুন হোসেন পার্লামেন্টের দুকক্ষের যৌথ অধিবেশন আহ্বানকরেছেন আজ।

সরকারপতনের আন্দোলনকে ঘিরে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে পাকিস্তানে। বিক্ষোভকারীরাসোমবার সকাল থেকে রাজধানী ইসলামাবাদের রেডজোনএলাকায় নতুন করে সংঘর্ষেজড়িয়ে পড়ে। দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলছে। দুপুরের দিকে বিক্ষোভকারীরা দেশটিররাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্র পিটিভির কার্যালয় ঘেরাও করে হামলা ওভাঙচুর চালায়। এতে স্টেশনটির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। নিরাপত্তা বাহিনীরহস্তক্ষেপে কিছু সময় পর এটি আবার সম্প্রচার শুরু করে। পরে বিক্ষোভকারীরাইসলামাবাদে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বাইরে অবস্থান নেয়। সেখানে তারাসরকারবিরোধী নানা স্লোগান দিচ্ছে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাওসেখানে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন। তবে এ সময় প্রধানমন্ত্রী তার বাসভবনে ছিলেনকিনা জানা যায়নি।এদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষবিশেষ ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীখাজা আশিফ। পিটিভি ভবনে হামলার কয়েক ঘণ্টা পর দেয়া একসাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সরকার এ ব্যাপারে রিট করতে দ্বিধা করবে না।পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলার বিরুদ্ধে তারা কঠোর ব্যবস্থা নেয়ারবিষয়টি বিবেচনা করছে। এ সময় তিনি গণগ্রেফতার করা হবে না বলে জানান। এর আগেরোববার সন্ধ্যায় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেনসেনাপ্রধান রেহাল শরিফ। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি নওয়াজ শরিফেরপ্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেন। সেনাবাহিনীর সাথে আঁতাত করে আন্দোলনে নেমেছেনইমরান খান বলে দাবি করেছেন পিটিআইয়ের বহিষ্কৃত প্রেসিডেন্ট জাবেদ হাশমি।ইতোমধ্যেইমরান খান ও ড. কাদরিসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। সন্ত্রাসীকর্মকাণ্ড, ইসলামাবাদ প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তি ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগেসচিবালয় থানায় এ মামলা করা হয়।

এক প্রতিবেদনে লিখেছে, এর মধ্যদিয়ে পাকিস্তানেসরকার পতনের পূর্বাভাস ফুটে উঠেছে। ওদিকে আন্দোলনরত পাকিস্তান তেহরিকেইনসাফ (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান ও পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিকের প্রধানতাহিরুল কাদরির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছে। এতে তাদেরবিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেয়া, হত্যা চেষ্টা, ডাকাতি ও রাষ্ট্রীয় বিষয়েহস্তক্ষেপের অভিযোগ আনা হয়েছে। জবাবে পিটিআই প্রধান ইমরান খান বলেছেন, আসলেনওয়াজের শাসনের ইতি ঘটার সময় এসে গেছে। সর্বোচ্চ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমরানওয়াজকে বিদায় জানাবো। গতকাল সকালে বুলেটবিদ্ধ হয়ে তার এক সমর্থক নিহতহয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। সকালে পাকিস্তান টেলিভিশন পিটিভি সদর দপ্তরেরভিতর জোর করে প্রবেশ করে প্রায় ৮০০ বিক্ষোভকারী। তারা বিভিন্ন সরঞ্জামভেঙে ফেলে। অনেক সরঞ্জাম সঙ্গে করে নিয়ে যায়। এ সময় কয়েক ঘণ্টা টেলিভিশনেরসম্প্রচার বন্ধ ছিল। পুরো পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। টেলিভিশন ভবনেরভিতরে দেখা যায় বিক্ষুব্ধ লোকজনকে। তাদের হাতে এ সময় ছিল লাঠিসোটা। পরেসেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং বিক্ষোভকারীদের ওই ভবন থেকে বেরকরে দেয়। এরপর স্বাভাবিক সম্প্রচারে ফেরে পিটিভি। পিটিভির ব্যবস্থাপনাপরিচালক মোহাম্মদ মল্লিক বলেছেন, এ ঘটনায় কেউ মারাত্মক আহত হন নি। তবে আমরাভীষণ ভীতসন্ত্রস্ত। ইমরান খান দাবি করছেন, পিটিভি সদর দপ্তরের ভিতরে যারাপ্রবেশ করেছে তারা পিটিআইয়ের কেউ নয়। তিনি বলেন, পুলিশি পোশাকে সরকার বাইরেথেকে লোক ভাড়া করেছে। তারা নির্যাতন চালাচ্ছে তার কর্মীদের ওপর। এ জন্যপ্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসারকে শাস্তি পেতেহবে। ওদিকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রাজধানী ইসলামাবাদেরগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি মোতায়েন করাহয়েছে বিপুল সংখ্যক আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশ। তারপরও বিক্ষোভকারীরাযখন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনের ভিতরে প্রবেশ করে তখন রাজনৈতিক সঙ্কট যেকতটা গভীরে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। এতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা আরও একবার প্রশ্নেরমুখে পড়লো। সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকার পরও যখন বিক্ষোভকারীরা টেলিভিশন ভবনেরভিতর প্রবেশ করে তখন ধরে নেয়া হয় যে, তারা আন্দোলনকারীদের প্রতি শৈথিল্যদেখিয়েছে। তবে পরে তারা ওই ভবন থেকে আন্দোলনকারীদের বের করে দিয়ে প্রমাণকরেছে যে, তারা সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। রোববার দিবাগত রাতে তারাপার্লামেন্ট হাউজের সামনে অভিযান চালিয়ে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দিয়েছে।কিন্তু কাউকে তখন গ্রেপ্তার করা হয় নি। পাকিস্তানে বর্তমানে একটি নির্বাচিতসরকার রয়েছে। এ সরকারের প্রতি সমর্থন রয়েছে প্রায় সব বিরোধী দলের। তাসত্ত্বেও সরকারকে একপেশে করে ফেলেছে বিরোধী রাজনৈতিক জোট পিটিআই ও পিএটি।শুধু কি তাদের পক্ষে একটি সরকারকে নামিয়ে দেয়া সম্ভব! এর নেপথ্যে রয়েছে কে? এমন প্রশ্ন এখন মুখে মুখে। তবে বেশির ভাগই সন্দেহের আঙুল উঠছে সেনাপ্রধানজেনারেল রাহিল শরিফের দিকে। কারণ, তিনি গতকাল প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফেরসঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে ৩০ দিনের জন্য পদত্যাগের যে অনুরোধ করেছেন সে দাবিপিটিআই প্রধান ইমরান খানের। ওদিকে গতকাল সকালে বিক্ষোভকারীরা সচিবালয়েরভিতরে প্রবেশ করে। গতকাল সেনাবাহিনীর কোর কমান্ডারদের নিয়ে সেনাপ্রধানেরবৈঠক করার কথা থাকলেও জরুরিভিত্তিতে সেই বৈঠক হয়েছে রোববার। এতে উপস্থিতসেনা কর্মকর্তারা সরকার ও বিক্ষোভকারীদের প্রতি সময় নষ্ট না করে সহিংসতাপরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করার আহ্বান জানিয়েছেন। পরে একবিবৃতিতে তারা বলেছে, তারা গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে আরওশক্তি ব্যবহার করলে তাতে সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। এর মাধ্যমেপ্রধানমন্ত্রী নওয়াজের ওপর চাপ বাড়ানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট সহিংসতায় অসন্তোষ প্রকাশ করে আন্দোলনকারীদলগুলোর কাছে জানতে চেয়েছেন, চলমান সঙ্কটে তারা কি ভূমিকা রাখতে পারেন।সংবিধানবহির্র্ভূত পদক্ষেপ ও ইসলামাবাদে অবস্থান ধর্মঘটের বিরুদ্ধে একটিআবেদনের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ গতকাল ওই মন্তব্য করেন। এ সময়উপস্থিত ছিলেন পিটিআই’র আইনজীবী আহমেদ আওয়াইস। বেঞ্চ তখন উভয় পক্ষেরআইনজীবীদের বলেন, তারা যেন তাদের দলীয় নেতাদের কাছে জানতে চান সঙ্কটসমাধানে সুপ্রিম কোর্ট কি ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এ শুনানিতে পিএটিরকোন আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন না। ওদিকে শনিবার শুরু হওয়া সরকার বিরোধীআন্দোলন গতকাল প্রকট আকার ধারণ করে। আন্দোলনকারী ও নিরাপত্তা রক্ষীদেরমধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলতে থাকে। সরকার বলছে, রক্তপাত এড়াতে তারা যথাযথপদক্ষেপ নিচ্ছে না। তবে সমালোচকদের অনেকের মতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফপিছুটান দিয়েছেন। তার সামনে খুব কম পথই খোলা আছে। এতে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছেযে, পাকিস্তান ফের ফৌজি শাসনের পথে হাঁটছে। বর্তমান অবস্থা যদি অব্যাহতথাকে তাহলে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা নেয়ার আশঙ্কাই বেশি।

নওয়াজ শরিফেরপদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন করছেন ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরি। রাজধানীইসলামাবাদে তারা হাজার হাজার সমর্থক নিয়ে অবস্থান করছেন প্রায় তিন সপ্তাহ।ঠিক ১৫ মাস আগে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ভূমিধস বিজয়েরমাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ। তিনি বিরোধীদের ওই দাবিকে অগ্রহণযোগ্য ওঅসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠারবিষয়ে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এতে রাজধানী অচল হয়ে গেছে। তার সরকার রয়েছেমারাত্মক দুর্বল অবস্থায়। এমন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার তিনি সেনাপ্রধানেরকাছে সহায়তা চান। এরপরই সেনাপ্রধান ইমরান খান ও তাহিরুল কাদরির সঙ্গেসমঝোতা প্রক্রিয়া শুরু করেন। কিন্তু সপ্তাহান্তে তা ব্যর্থ হয়। ওদিকে ইমরানখানের দল পিটিআই’র সভাপতি জাভেদ হাশমি বিপরীত অবস্থান নিয়েছেন। তিনি একসংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ইমরান খান দলের সিনিয়র নেতাদের সিদ্ধান্ত টপকেআন্দোলন উস্‌কে দিচ্ছেন। তাকে উস্কানি দেয়া হচ্ছে বাইরে থেকে। বাইরে থেকেউস্কানি বলতে তিনি সামরিক হস্তক্ষেপকে বোঝাতে চেয়েছেন। জাভেদ হাশমি বলেন, দেশে যদি সামরিক শাসন জারি হয় তাহলে তার জন্য দায়ী থাকবেন ইমরান খান। এরপরই ইমরান খান বলেন, তিনি জাবেদ হাশমির বিবৃতিতে হতাশ। এখন তাদের দু’জনারপথ আলাদা।