পুলিশ সুপারের প্রস্থানের পরও বাস্তবায়ন হোক ইতিবাচক নির্দেশনা

অবৈধযানের অবৈধ চালকের হাতে প্রাণহানি হত্যারই সামিল। সে কারণেই এ ধরনের অপমৃত্যুকে আইনের দৃষ্টিতেও অনিচ্ছাকৃত হত্যা হিসেবে দেখা হয়। অথচ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের মাঠপর্যায়ে কর্মরত কর্তাদের মধ্যে এ আইন প্রয়োগে দীর্ঘদিন ধরেই উদাসীনতাটাই পরিলক্ষিত হয়। তবে সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার নিজাম উদ্দীনের বিশেষ নির্দেশনায় পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টেছে। শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধযানের অবৈধ চালকের হাতেই শুধু নয়, চালক হিসেবে স্বীকৃতিপত্র পাওয়ার আগে গাড়ি চালাতে গেলে তার হাতে দুর্ঘটনা ঘটলেও অনিচ্ছাকৃত হত্যার অভিযোগে মামলা হচ্ছে। আইনের এ ইতিবাচক প্রয়োগ অবশ্যই সড়কগুলোকে অনেকটাই নিরাপদ করে তুলতে সহায়ক হবে। অবশ্য যদি আইন প্রয়োগের ধারা অব্যাহত থাকে তবেই মিলবে সুফল। যদিও অবস্থাদৃষ্টে এ আশা করা আর বোকার স্বর্গে বাস করা সমান কথা।
শ্যালোইঞ্জিন চালিত হরেক নামের রকমারি যানের একটিরও বৈধতা নেই। মাঝে ‘গ্রামবাংলা’ নামের একটি যানের সময়িক বৈধতা দেয়া হলেও এসব যান নিরাপদ না হওয়ায় পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে অবৈধ ঘোষণা করে পরিপত্র জারি করা হয়। জারিকৃত পরিপত্রের নির্দেশনাবলী জেলা উপজেলা প্রশাসনকে বাস্তবায়নের পুনঃপুনঃ নির্দেশনা দেয়া হলেও বাস্তবে ফল মিলেছে উল্টো। কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট, কৃষিপণ্য পরিবহনে সহজলভ্যসহ নানা যুক্তির অজুহাতে স্থানীয়ভাবে ওই যানগুলোর মালিক-চালকেরা সুযোগই পেয়েছে। প্রশাসনিকভাবে বিষয়টি স্বীকার করা না হলেও বাস্তবের আলোকে সমাজের সাধারণ মানুষ তা অস্বীকার করে না। অবৈধযানের বদৌলতে বহু পরিবারে সচ্ছলতা এসেছে বলে যেমন দাবি করা হয়, তেমনই ওই যান ও তার আনাড়ি চালকের কারণে বহু পরিবারে চেপে বসেছে পঙ্গুত্বের অভিশাপ। প্রাণ হারিয়েছে বহু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পুরুষ। পথে বসতে হয়েছে বহু পরিবারকে। অপরাধ অন্যায় করেও কেউ পার পেলে সমাজে অনায়ের প্রবণতা বাড়ে। একের পর এক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পরও অবৈধযানের চালকদের পার পাওয়ার প্রবণতা দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের সড়কগুলোকে যে মৃত্যুপুরী বানিয়েছে তা বলাই বাহুল্য। পার পাওয়ার কারণে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। দেদারছে তৈরি হচ্ছে অবৈধযান। দানবরূপে চালানোর কারণে প্রায় প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা। ঝরছে তরতাজা প্রাণ। গতপরশু চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গার আঠারখাদা গ্রামের অবৈধযানের অবৈধ চালকের হাতে ফুটফুটে এক কন্যাশিশুর প্রাণ হারায়। স্থানীয়রা অবৈধ চালককে আটক করে। এরপর শুরু হয় আপস-মীমাংসার পাঁয়তারা। এলাকার ফাঁড়ি পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর আটককৃত চালককে ধরতে গেলে আপস অজুহাত আইন প্রয়োগে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত নিহত শিশুর পিতা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করবেন বলে ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। শিশুর লাশ ময়নাতদন্ত করা হয়। পুলিশের ইতিবাচক অবস্থানের কারণে ময়নাতদন্ত পর্যন্ত হলেও গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অবশ্য মামলা হয়নি বলে জানা গেছে। পুনরায় নাকি আপসের প্রক্রিয়া শুরু হয়। শিশুর পিতা বাদী না হলে পুলিশ বাদী হয়েও তো মামলা রুজু করার এখতিয়ার আইনে রয়েছে। যদিও পুলিশের তরফে তেমন নজির এখন আর তেমন নজরে পড়ে না। পড়বে কীভাবে? হতাহতের পর অর্থের বিনিময়ে আপস হলেই যদি হিস্যা পৌঁছায় ফাঁড়ি ও থানা কর্তার পকেটে তাহলে কি আইন আইনের গতিতে থাকে? দীর্ঘদিন গোপনে চলা এ রেওয়াজ ভেঙে সমাজের কল্যাণে আইন প্রয়োগে যে পুলিশ সুপার অগ্রণী ভূমিকা রেখে দৃষ্টান্ত স্থাপনের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন, তিনি ইতোমধ্যেই চুয়াডাঙ্গা থেকে বদলির আদেশ পেয়েছেন। প্রস্থানের পর থাকবে কি তার এই ইতিচাক নির্দেশনার বাস্তবায়ন? তিনি থাকতেই মামলা রুজুর বিষয়টি অনিশ্চয়তা, না থাকলে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে তা বলা কঠিন।
আইন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ অবশ্যই সমাজের স্বার্থেই নিয়োজিত। আইন প্রয়োগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের কোনো কোনো কর্মকর্তা উদাসীন হলে তার ক্ষতিকর প্রভাব সমাজের ওপর পড়ে। অবৈধযানের সংখ্যা বৃদ্ধি, সংখ্যা এবং তার উপকারভোগী নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে পৌঁছুনোর দায় প্রশাসন এড়াতে পারে না। এখন যেহেতু পরিস্থিতি বেসামাল সেহেতু সড়ক নিরাপদ করার বিশেষ উদ্যোগ মানেই বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ। অবৈধযানের বেপরোয়া গতি, চালকের বেপরোয়া মতি রুখতে অবশ্যই দরকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ। বৈধ যানেরই যদি লাসেন্সবিহীন চালকের হাতে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে তাহলেও যখন অনিচ্ছাকৃত হত্যার দৃষ্টিতে দেখার বিধান, তখন অবৈধযানের ক্ষেত্রে কেন নয়? প্রয়োগ না থাকলে আইন থেকে লাভ কী? প্রয়োগের কাজে নিয়োজিতদের মাসে মাসে মায়না দেয়াটাও সেক্ষেত্রে অপচয়।