মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ : মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধারের পর শিশু অন্তরের মৃত্যু

মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ : মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধারের পর শিশু অন্তরের মৃত্যু
মাজেদুল হক মানিক: নিখোঁজের তিন ঘণ্টার পর স্কুলছাত্র অন্তরকে (৭) মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হলেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। উদ্ধারের সময় নিভু নিভু করা অন্তর আত্মা শেষ পর্যন্ত সবাইকে কাঁদিয়ে সমাজের ওপর কিছু প্রশ্ন ছুড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে। মুক্তিপণের দাবিতে অপরণ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানায় পরিবার ও এলাকাবাসী। নিহত অন্তর মেহেরপুর গাংনী উপজেলার বাওট গ্রামের সৌদি আরব প্রবাসী কাফিরুল ইসলামের ছেলে। সে বাওট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিলো।
অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত একই গ্রামের চিহ্নিত সন্ত্রাসী সবুজ অল্পের জন্য গ্রামবাসীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অন্তত ৫টি মামলার আসামি সবুজ। মাঝেমধ্যে হাজতবাস হলেও তাকে কেন বারবার জামিন করা হচ্ছে এবং কেন পৃষ্ঠপোষকতা করা হচ্ছে? সে প্রশ্ন এখন সকলের মুখে মুখে। তাকে পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই অন্তরের এমন নির্মম পরিস্থিতি উল্লেখ করে বুকফাটা কান্না আর দীর্ঘশ্বাস এখন গ্রামবাসীর। তার পক্ষে সাফাই গাওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কেও তীব্র সমালোচনার তীর ছুড়েছেন গাংনী থানার ওসি। গ্রামবাসীর সেই ক্ষোভের আগুনে অবশ্য সবুজের বাড়িঘর ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য সন্ধ্যার পর থেকে সবুজের পিতা-মাতাসহ পরিবারের সবাই আত্মগোপনে রয়েছে। তাদেরকে খুঁজে বের করতে গ্রামবাসী রাতভর বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি করেছে।
নিহত অন্তরের পরিবার ও গ্রামসূত্রে জানা গেছে, ছোট ভাই জাকিরুল সিঙ্গাপুর থেকে বাড়ি ফিরলে সম্প্রতি নিজ বাড়িতেই বিদ্যুতস্পৃষ্টে নিহত হয়। এ খরব পেয়ে গত ২ মাস আগে ছুটিতে বাড়ি ফিরেছেন অন্তরের পিতা। এক ছেলে ও এক মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে ভালোই কাটছিলো তার ছুটির সময়। প্রতিদিনের ন্যায় গতকাল বিকেলে অন্তরকে বাড়ির পার্শ্ববর্তী বাওট সোলাইমানী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে খেলার জন্য রেখে অন্যত্র চলে যান কাফিরুল ইসলাম। সন্ধ্যায় তিনি বাড়ি ফিরলেও ছেলে না ফেরায় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। কিন্তু কোথাও কোনো খোঁজ না পেয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে গ্রামের মসজিদের মাইকে নিখোঁজ সংবাদ প্রচার করা হয়। এরপরও কোনো হদিস না মেলায় ‘আসন্ন বিপদের অশনি সঙ্কেত’ নাড়া দিতে থাকে পিতা-মাতার মনে। গ্রামবাসীর প্রচেষ্টায় রাত পৌনে ৯টার দিকে বিদ্যালয়ের কমনরুমের মধ্যে অন্তরের সন্ধান মেলে।
উদ্ধারের সাথে সম্পৃক্ত কয়েকজন জানান, অন্তরের হাত-পা কাপড় দিয়ে পেছনের দিকে বাঁধা ছিলো। মুখও ছিলো বাঁধা। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে দ্রুত বামন্দীর একটি ক্লিনিকে নেয়া হয়। সেখান থেকে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসাতালে নেয়া হলে রাত ১০টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক অন্তরকে মৃত ঘোষণা করেন। মৃত্যুর খবরে পিতা-মাতা মুর্ছা যাওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী থেকে শোক ছাপিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা গ্রামের মানুষের মাঝে। অন্তর হারানো পরিবারে এখন চলছে শোকের মাতম।
নিহতের পরিবার ও গ্রামের কয়েকজন জানান, অন্তরের প্রতিবেশী গোলাম মোস্তফার ছেলে সবুজ হোসেন মুক্তিপণের দাবিতে অন্তরকে কৌশলে অপহরণ করে। সবুজের বাড়ির ভেতর দিয়েই কাফিরুলের পরিবারের লোকজনের চলাফেরার পথ। খেলার মাঠ থেকে অন্তর বাড়ি ফেরার পথে কৌশলে সবুজ তাকে অপহরণ করে নিজ ঘরের মধ্যে হাত-পা বেঁধে আটকে রাখে। গ্রামের মানুষের তৎপরতায় কোনো কিছু করতে না পেরে অন্তরকে শ্বাসরোধ করে অথবা বৈদ্যুতিক শক দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছে গ্রামবাসী।
কাফিরুলের ঘনিষ্ঠ একই গ্রামের সাহাবুল ইসলাম জানান, সন্ধ্যার পর কাফিরুলের ভাই জাব্বারুল ইসলামের কাছ থেকে কাফিরুলের ব্যবহৃত মোবাইলফোন নম্বর সংগ্রহের চেষ্টা করে সন্ত্রাসী সবুজ। এতে পরিবারের সন্দেহ বেড়ে যায়। পরে সবুজকে গ্রামের লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার কথাবার্তায় অসঙ্গতি ধরা পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে কৌশলে সেখান থেকে সটকে পড়ে সবুজ। এর কিছুক্ষণ পরেই সবুজের বসত ঘরের পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ের কমনরুম থেকে অন্তরকে উদ্ধার করা হয়।
অন্তরকে অপহরণের পর তার পিতার মোবাইল নম্বর জোগাড় করে মুক্তিপণ দাবি করার পাঁয়তারা চলছিলো বলে ধারণা করছে পুলিশ ও গ্রামবাসী। কিন্তু গ্রামের মানুষের তৎপরতায় বিষয়টি সামলাতে না পেরে তাকে হত্যার উদ্দেশে শ্বাসরোধ করা হয়েছে বলেও ধারণা তাদের।
অন্তরকে উদ্ধার করা ওই কমনরুমের পেছনে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সেপটিক ট্যাংক। ওই ট্যাংকের উপরের অংশ ভেঙে ফাঁকা করা হয়। অন্তরকে হত্যা করে ট্যাংকের মধ্যে ফেলে রাখার সিদ্ধান্ত ছিলো বলে ধারণা গ্রামবাসীর। এছাড়াও অন্তরকে বেঁধে রাখা শাড়ির ছেড়া কাপড় সবুজের পরিবারের কারো বলেও মনে করছেন তারা। অন্তরকে খোঁজার এক পর্যায়ে যখন গ্রামের লোকজন সবুজের বাড়িতে যায় তখন ঘরের মধ্যে শাড়ির ছেড়া কিছু টুকরা দেখতে পান তারা। এতে তারা ধারণা করছেন যে, অন্তরকে অপহরণ করে প্রথমে সবুজের ঘরেই মধ্যেই রাখা হয়। পরে বিদ্যালয়ের সেপটিক ট্যাংকের মধ্যে ফেলার উদ্দেশে বিদ্যালয়ের কমনরুমে নেয়া হতে পারে। তবে ঘটনার সাথে সবুজ ও তার পরিবারের সদস্যরা ব্যতীত অন্য কেউ জড়িত কি-না তা নিশ্চিত নন গ্রামবাসী।
এদিকে অন্তর উদ্ধারের আগেই সবুজের রহস্যময় আত্মগোপন গ্রামবাসীর মধ্যে অজানা এক আশঙ্কার জন্ম দেয়। উদ্ধার ও মৃত্যুর পর সেই আশঙ্কা সত্যি হলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে গ্রামের নানা বয়সী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। শোকে মুহ্যমান এলাকাবাসী সবুজ ও তার পরিবারের লোকজনকে খুঁজতে মাঠ থেকে গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী মহম্মদপুর ও হোগলবাড়ীয়া গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে তল্লাশি করে। গতরাত ৩টার দিকে এ সংবাদ লেখা পর্যন্ত সবুজের কোনো হদিস মেলেনি। তবে বিক্ষুদ্ধ উত্তেজিত গ্রামবাসী সবুজের বাড়িঘর ভাঙ্চুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়।
এদিকে খবর পেয়ে রাতেই গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকরাম হোসেন ও কুমারীডাঙ্গা পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ এএসআই সুফল সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে গ্রামবাসীর সাথে সবুজকে আটকের অভিযানে যোগ দেন। এ সময় সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওসি। তিনি বলেন, বাওট গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ইউপি সদস্য নিয়ামত আলী এবং হোগলবাড়িয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা মনিরুজ্জামান আতু প্রায়ই সবুজের বিষয়ে তদবির করতেন। তারা দুজন মিলে সম্প্রতি তাকে জামিন করে বাড়ি নিয়ে আসে। সবুজকে ভালো মানুষ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করে পুলিশ সুপারের কাছেও সহযোগিতা কামনা করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের এই দু নেতা।
তিনি আরো বলেন, সবুজের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য ও ইটভাটায় মোবাইলে চাঁদাবাজিসহ গাংনী থানায় ৫টি মামলা রয়েছে। চলতি বছরের ১৬মার্চ তাকে বাওট গ্রাম থেকে সর্বশেষ গ্রেফতার করেছিলো গাংনী থানা পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পুলিশকে দেয় সবুজ। তাই সবুজের জামিন হলে তার ওপর বিশেষ নজরদারি করার চেষ্টা ছিলো পুলিশের।
এদিকে গ্রামবাসী ওই দু নেতার ওপর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে অন্তর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জবাব দাবি করেছেন। সবুজ জামিন না হলে কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা না করলে অন্তরের ভাগ্যে এমন নির্মর্ম ঘটনা ঘটতো না বলে ক্ষোভ জানান গ্রামবাসী। কেন এবং কোন স্বার্থে সবুজকে জামিন করা হলো সে প্রশ্নের উত্তর চাই পরিবার ও গ্রামবাসী।
গাংনী থানার ওসি আকরাম হোসেন আরো জানান, নিহত অন্তরের লাশ কুষ্টিয়া মেডিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে আজ দুপুরের দিকে বাড়ি পৌছাতে পারে। এ ঘটনায় মামলার দায়েরের প্রস্তুতির পাশাপাশি সবুজকে গ্রেফতারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। যে কোনো মূল্যে তাকে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করতে পুলিশের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে বলেও জানান তিনি।