বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মরসুমি নিম্নচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ারে উত্তাল সাগর
স্টাফ রিপোর্টার: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মরসুমি নিম্নচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ারে উত্তাল হয়ে উঠেছে সাগর। আগামী ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজার উপকূলীয় এলাকায় জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানতে পারে বলে আবহাওয়া বিভাগ সতর্ক বার্তা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতিও গ্রহণ করা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকা থেকে লোকজনকে গত মঙ্গলবার বিকেল থেকেই সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে।
আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, নিম্নচাপটি কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল থেকে ১৮৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থান করছে, যা ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে কক্সবাজারের দিকে এগিয়ে আসছে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। এ কারণে উপকূলীয় এলাকার নিম্নাঞ্চল ৩ থেকে ৪ ফুট জ্বলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। কক্সবাজার থেকে পর্যটকদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৪নং স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। কক্সবাজার আবহাওয়া অধিদফতরের সহকারী আবহাওয়া কর্মকর্তা একেএম নাজমুল হক এ তথ্য জানিয়েছেন। গতকাল বুধবার দুপুর থেকে কক্সবাজার সমুদ্র এলাকায় হঠাত করে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করে। ঝড়ো হাওয়ায় শহরের ঘোনারপাড়া, পাহাড়তলী, কলাতলী, লাইট হাউস, বাদশাঘোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি কাঁচা বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিদ্যুত সরবরাহ। এদিকে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ফলে উপকূলীয় এলাকা থেকে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করেছে প্রশাসন। গতকাল বুধবার রাত ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শহরের উপকূলীয় এলাকা সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়া পাড়া, বন্দরপাড়া, ফদনার ডেইল, কলাতলী, বড় ছড়াসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় সহস্রাধিক লোকজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কক্সবাজারের সক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। কক্সবাজারের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ড. অনুপম সাহা বলেন, উপকূলীয় এলাকার মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার পাশাপাশি পরবর্তী সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এদিকে টানা বর্ষণ ও সাগরের জোয়ারের পানিতে কক্সবাজারের নিম্নাঞ্চল গত এক সপ্তাহ ধরে পানির নিচে। কমেনি বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ। উজান থেকে নেমে আসছে পাহাড়ি ঢল। জেলায় শতাধিক গ্রামের ৩ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। ফলে এসব এলাকায় জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। পূর্ণিমা তিথির কারণে জোয়ারের পানিতে জেলার উপকূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় বিভিন্ন জেলা এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বিরাজমান সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। ভারী বর্ষণ তুলনামূলক কমে যাওয়ায় বুধবার বিভিন্ন নদীতে পানিপ্রবাহ কমেছে। কয়েক দিনের গোমরা অবস্থা কাটিয়ে এদিন ঢাকায় নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা এখন খেলা করছে। তবে বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এ কারণে উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন দ্বীপ ও চরাঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস দেখা দিতে পারে বলে আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করছেন। জলোচ্ছ্বাসের পাশাপাশি এসব এলাকায় ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। ভারী বৃষ্টিপাতেরও সম্ভাবনা রয়েছে। এখনও দেশের দুটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে। মঙ্গলবারও সাতটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে ছিলো।
আবহাওয়াবিদ ও নদী বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উত্তর বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি ঘনীভূত হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। এ কারণে আগামী দুদিন কক্সবাজার ও তৎসংলগ্ন বন্যাপ্রবণ এলাকায় আকস্মিক বন্যার সতর্কতা জারি থাকবে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টিপাত আগামী আরও দুদিন অব্যাহত থাকতে পারে। বিশেষ করে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৩টি জেলায় ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এসব এলাকার দূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সমুদ্রবন্দরগুলোতে জারি করা ৩ নম্বর ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে ২ নম্বর স্থানীয় সঙ্কেত বহাল রাখা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্রের (এনডিআরসিসি) বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি ও বুলেটিনে বৃষ্টিপাত ও বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। তাদের তথ্যানুযায়ী, এ মুহূর্তে দেশের অন্তত দুটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী যশোরের ঝিকরগাছা পয়েন্টে কপোতাক্ষ নদীর পানি নতুন করে বাড়েনি। তবে এখনও বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। আর চট্টগ্রামের দোহাজারী পয়েন্টে সাংগু নদীর পানি এক দিনেই ৫৫ সেন্টিমিটার কমেছে। কিন্তু এখনও বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এ নদীর পানি। এ দু নদীর বাড়তি পানির কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া আরও তিনটি স্থানে দুটি নদীর পানি সীমার কাছাকাছি পৌঁছেছে। সিলেটের কানাইঘাট স্টেশনে সুরমা নদীর, একই জেলার শেওলা স্টেশন ও অমলশীদ স্টেশনের কাছে কুশিয়ারা নদীর পানি, কক্সবাজারে মাতামুহুরী নদী চিড়িঙ্গা স্টেশনের কাছে বিপদসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। তবে এখনও বিপদসীমার ৫০ সেন্টিমিটারের মধ্যে পানি বইছে। চট্টগ্রামের হালদা নদীতে মঙ্গলবার পানি বিপদসীমা স্পর্শ করলেও বুধবার তা কমেছে। তবে তিস্তার পানি নীলফামারীর ডিমলায় ডালিয়া পয়েন্টে গত কয়েক দিনের মতোই বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে।
পদ্মা-মেঘনাসহ প্রধান নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী রিপন কর্মকার জানান, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা আগামী ২৪ ঘণ্টা স্থিতিশীল থাকবে। গঙ্গা-পদ্মা ও সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি অবশ্য হ্রাস পাচ্ছে। নদী বিশেষজ্ঞরা জানান, ভারত থেকে বাংলাদেশে এ ৬ নদীর লাইনেই সব মিঠা পানি প্রবেশ করে। ভারতের পূর্বাঞ্চল আর বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টিপাত কমেছে। বিশেষ করে ভারি বর্ষণ হওয়া এলাকার সংখ্যা কমেছে। এ কারণে আগামী ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজার, ফেনী, চট্টগ্রাম, বান্দরবান জেলার কিছু স্থানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটতে পারে।
আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, মরসুমি বায়ু দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সক্রিয় আছে। এটি উত্তর বঙ্গোপসাগরে রয়েছে প্রবল সক্রিয় অবস্থায়। এটি আরও ঘনীভূত হতে পারে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকা ও সমুদ্রবন্দরের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। তাই আগামী কয়েক দিন দিনে কম রাতে বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এ অবস্থা আগামী দুদিন অব্যাহত থাকতে পারে। গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, বরিশাল, চাঁদপুর, ভোলা, খুলনা, পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরার দূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। নদীগুলোতে বিভিন্ন নৌযানকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।