আপিলে সালাহউদ্দিন কাদেরের ফাঁসি বহাল

গণহত্যা হত্যা সংখ্যালঘুদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করাসহ চারটি অপরাধে দোষী

 

স্টাফ রিপোর্টার: ১৯৭১ সালে গণহত্যা, হত্যা, সংখ্যালঘুদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করাসহ চারটি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।

মধ্য গহিরা হিন্দুপাড়া ও জগতমল্লপাড়া গণহত্যার ঘটনায় তাকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া ৪০ বছরের দণ্ডও বহাল রেখেছেন আদালত। তবে সতীশ চন্দ্র পালিতকে হত্যার দায় থেকে সালাহউদ্দিন কাদেরকে খালাস দেয়া হয়েছে। এছাড়া একাত্তরে নিজামউদ্দিন ও সালেহউদ্দিনকে আটক রেখে নির্যাতনের দায়ে ১০ বছরের দণ্ড আপিল বিভাগের রায়ে বহাল রয়েছে।

গতকাল প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, এই রায়ে আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। কারণ যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার দায়ে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর যে ভূমিকা ছিল, সেটি ভয়াবহ। অপরদিকে সালাহউদ্দিন কাদেরের ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেন, আমার পিতা নির্দোষ। দেশবাসীর কাছে এটা একদিন প্রমাণ হবে। সালাহউদ্দিনের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন জানিয়েছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করা হবে। আমরা আশা করি রিভিউয়ে বহালকৃত সাজা থেকে সালাহউদ্দিন মুক্তি পাবেন।

২০১৩ সালের ১ অক্টোবর যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালাহউদ্দিন কাদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর তিনি ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আপিল দায়ের করেন। চলতি বছরের ১৬ জুন এই আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। ১৩ কার্যদিবসব্যাপি আপিলের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল সকাল ৯টা ৩ মিনিটে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাসহ আপিল বিভাগের চার বিচারপতি এজলাসে আসেন। বেঞ্চের অপর বিচারকরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এজলাস কক্ষ ছিলো জনাকীর্ণ। এ সময় আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, সাংবাদিক ও বিশিষ্ট নাগরিকরা আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। সকাল ৯টা ৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা শুরু করেন। এক মিনিটের মধ্যে রায় পড়া শেষ হয়। ঘোষণায় বলা হয়, আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হয়েছে।

চার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল: সালাহউদ্দিন কাদেরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি অভিযোগ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে ৩ নম্বর অভিযোগ (একাত্তরের ১৩ এপ্রিল সকালে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে রাউজানের গহিরা গ্রামের কুণ্ডেশ্বরী ওষুধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতনচন্দ্র সিংহের বাড়িতে অভিযান চালান। মন্দিরে প্রার্থনারত নূতনচন্দ্রকে টেনেহিঁচড়ে বের করে পাকিস্তানি সেনারা গুলি করলে নতুনচন্দ্র আহত অবস্থায় কাতরাতে থাকেন, তখন সালাহউদ্দিন চৌধুরী নিজে গুলি করে নতুনচন্দ্রের মৃত্যু নিশ্চিত করেন); ৫ নম্বর অভিযোগ (একাত্তরের ১৩ এপ্রিল দুপুরে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের বণিকপাড়ায় গিয়ে গণহত্যা চালান এবং বাড়িঘরে আগুন দেন); ৬ নম্বর অভিযোগ (একাত্তরের ১৩ এপ্রিল বিকালে সালাহউদ্দিন পাকিস্তানি সেনাদের সাথে নিয়ে রাউজানের হিন্দু-অধ্যুষিত ঊনসত্তরপাড়া গ্রামে সশস্ত্র অভিযান চালান। তার উপস্থিতিতে সেনারা এলোপাতাড়ি গুলি করে ৬০-৭০ জনকে হত্যা করে) এবং ৮ নম্বর অভিযোগে (চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোজাফফর আহমেদ ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে অপহরণ করে হত্যা) সালাহউদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের এই দণ্ড বহাল রেখেছেন।

দুটি অভিযোগে ৪০ বছরের কারাদণ্ড: ২ নম্বর অভিযোগ (মধ্য গহিরা হিন্দুপাড়ায় গণহত্যা) এবং ৪ নম্বর অভিযোগ (জগত্মল্লপাড়া গণহত্যা) এ ট্রাইব্যুনাল এই বিএনপি নেতাকে ২০ বছর করে ৪০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগ রায়ে তা বহাল রেখেছেন।

দুটি অভিযোগে ১০ বছরের দণ্ড: ১৭ নম্বর অভিযোগ (একাত্তরের ৫ জুলাই নিজামউদ্দিনসহ তিনজনকে আটকে রেখে নির্যাতন) এবং ১৮ নম্বর অভিযোগে (জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে সালেহউদ্দিনকে আটকে রেখে নির্যাতন) সালাহউদ্দিনকে ৫ বছর করে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ এই দণ্ড বহাল রেখেছেন।

একটি অভিযোগ থেকে খালাস: ৭ নম্বর অভিযোগে (সতীশচন্দ্র পালিতকে হত্যা) ট্রাইব্যুনাল তাকে ২০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। কিন্তু আপিল বিভাগ সালাহউদ্দিনের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে এই অভিযোগের দায় থেকে তাকে খালাস দিয়েছেন।

এ রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের প্রতিটি প্রবেশ ফটকে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। এছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের নজরদারিও বাড়ানো হয়।

যারা মামলা পরিচালনা করেন: আপিলের ওপর সালাহউদ্দিনের পক্ষে আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, এসএম শাহজাহান, তানভীর আহমেদ আলামিন এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা ও মোমতাজউদ্দিন ফকির এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ মামলা পরিচালনা করেন।

আমার বাবা নির্দোষ: সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোট ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী বলেছেন, আমার পিতা নির্দোষ। আশা করি, এই সত্য প্রমাণ হবে। একদিন না একদিন প্রমাণিত হবে যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী একজন নির্দোষ মানুষ ছিলেন। আপিলের রায় ঘোষণার পর সালাহউদ্দিনের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

রিভিউ করা হবে: আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ পিটিশন দাখিল করা হবে বলে জানিয়েছেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। রায় ঘোষণার পর তিনি বলেন, আমরা রায়ের অনুলিপি হাতে পেলে রিভিউ করবো। আমরা আশা করি রিভিউয়ে বহালকৃত সাজা থেকে তিনি মুক্তি পাবেন। তার পরিবার থেকে বলা হয়েছে, তারা এই রায়ে হতাশ হয়েছেন।

খন্দকার মাহবুব বলেন, যে এলাকায় বর্বরোচিত পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার সাথে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছিলেন বলে বলা হয়েছে সেই নিজ এলাকা থেকে তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে বার বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি যদি এসব অপরাধে জড়িত থাকতেন তাহলে কি বার বার এমপি নির্বাচিত হতে পারতেন?

সন্তোষ প্রকাশ আইনমন্ত্রীর: আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এখন যাদের রায় হচ্ছে তারা একাত্তর সালের পরেও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। তারা এবং তাদের যারা পুনর্বাসিত করেছেন তারা কতোটা ভুল করেছেন তা এ রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, এজন্য আমি খুশি। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিলের রায়ের পর গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ প্রতিক্রিয়া দেন তিনি। রিভিউ দায়ের প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, রিভিউয়ের আবেদন করলে মূল আদেশ পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ আপিল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের রায়ে কোনো ভুল পাননি।

জনগণের জন্য রাজনীতি করেছি: সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছেন, আমি দেশ ও জনগণের জন্য আজীবন রাজনীতি করেছি। এ কারণেই আমি আজ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। গতকাল বুধবার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পর তার সাথে দেখা করতে গেলে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১’র সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা ও জেলার ফরিদুর রহমান রুবেলকে তিনি একথা বলেন বলে কারাসূত্র জানিয়েছে।

সুব্রত কুমার বালা সাংবাদিকদের জানান, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে এক ব্যান্ডের একটি রেডিও আছে। ওই রেডিওতে প্রচারিত খবরের মাধ্যমে তিনি আপিলের রায় জেনেছেন। তিনি বলেন, রায় শোনার পর তিনি সুস্থ ও স্বাভাবিক আছেন। তাকে চিন্তিত দেখা যায়নি।