দামুড়হুদায় বেশির ভাগ শিশু-কিশোরদের হাতেই দেখা যাচ্ছে স্মার্ট মোবাইলফোন

হচ্ছে অপব্যবহার : অধিকাংশের মতামত অভিভাবকরাই দায়ী

 

বখতিয়ার হোসেন বকুল: দামুড়হুদা উপজেলা শহরের বেশির ভাগ শিশু-কিশোরদের হাতেই দেখা যাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির ইন্টারনেট সংযুক্ত মোবাইল হ্যান্ডসেট। দেশের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী সকলেই শিশু হিসেবে গণ্য। আর এ সমস্ত শিশু-কিশোরদের মোবাইলফোন ব্যবহারের নিয়ম না থাকলেও বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করেই অধিকাংশ শিশু-কিশোরই ব্যবহার করছে আধুনিক প্রযুক্তির এসব মোবাইল হ্যান্ডসেট। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের হাতেও দেখা মিলছে এ সমস্ত স্মার্ট মোবাইলফোন। মোবাইলের মাধ্যমে শিশুরা শুধু যে তার পরিবারের সদস্য বা বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে তা নয়, এর মাধ্যমে পর্নো ছবির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে অনেকেই। হচ্ছে অপব্যবহার। শ্রেণিকক্ষে বা কোচিঙে পড়তে গিয়ে মোবাইলফোনের ক্যামেরা দিয়ে ছেলে শিক্ষার্থীরা তুলছে সহপাঠী মেয়ে শিক্ষার্থীদের ছবি। পরে ছবিগুলো অপব্যবহার করে ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্য সহপাঠীদের মোবাইলফোনে, ইন্টারনেটে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। হঠাত মোবাইলফোন হাতে পেয়ে কৌতুহলবশত অবুঝ মেয়ে শিক্ষার্থীরা স্বল্প সময়ের কথোপকথনে অপরিচিতদের সাথে জড়িয়ে পড়ছে প্রেমসম্পর্কে। এদের অনেকেই পরবর্তীতে ফোনে কথা বলা যুবকের সাথে দেখা করতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আর প্রতারিত হয়ে আবেগবশত ওই কিশোরীরা কখনও বা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। শিশু-শিক্ষার্থীদের মোবাইল হ্যান্ডসেটের আবদার পূরণ করছেন খোদ অভিভাবকরাই। আর এ সামজিক অবক্ষয়ের জন্য অভিভাবকরাই দায়ী বলে মতামত প্রকাশ করেছেন এলাকার বিশিষ্টজনেরা।

সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বরণ ও বিদায় অনুষ্ঠানে আগত অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের হাতেই দেখা গেছে আধুনিক প্রযুক্তির মোবাইলফোন। আর ওই সমস্ত মোবাইলফোন দিয়ে তুলতে দেখা গেছে আমন্ত্রিত অতিথিসহ উপস্থিত সহপাঠীদের ছবি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দামুড়হুদা পাইলট মডেল হাইস্কুলের নবম শ্রেণির এক ছাত্র জানায়, মা-বাবার কাছে আবদার করেই মোবাইল হ্যান্ডসেট কিনেছি। অনেকেই ক্লাসের বিরতীতে এবং টিফিন টাইমে গোপনে গোপনে কথা বলে। এদের অনেকেই আবার মোবাইলে খারাপ ছবিও দেখে এবং অন্যদের দেখতে উৎসাহিত করে। ওই ছাত্র আরো জানায়, শুধু যে ছেলে শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করছে তা নয় মেয়ে শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে নেই কোনো অংশে।

এ বিষয়ে দামুড়হুদা পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি ইসমাইল হোসেন বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মোবাইলফোন ব্যবহার করতে দেয়া ঠিক না। কারণ এর ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহারই হয় বেশি। তিনি আরো বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী স্কুলব্যাগের মধ্যে গোপনে মোবাইলফোন নিয়ে আসতো। কিন্তু এখন আর সে সুযোগ নেই। কারণ সন্দেহ হলেই আমরা ব্যাগ চেক করি। মোবাইলফোন পেলে কেড়ে নেয়া হয় এবং অভিভাবককে ডেকে বিষয়টি জানানোর পরই মোবাইলফোন ফেরত দেয়া হয়।

দামুড়হুদা পাইলট মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, আমার মতে ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মোবাইলফোন ব্যবহার করতে না দেয়াটাই ভালো। বিদ্যালয়ে গোপনে কেউ ব্যবহার করলে করতে পারে। প্রকাশ্যে নয়। তবে সন্তান মোবাইলে কি করছে কি দেখছে তা অভিভাবককে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ফরিদুর রহমান বলেন, নিয়ম করে শিশুদের মোবাইলফোন ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। এজন্য অভিভাকদের সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষার। এছাড়া স্থানীয় বাজারের মোবাইলফোন সার্ভিসের দোকানিরা রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই অবৈধভাবে সিম বিক্রি করছে। অল্প পয়সায় হাতের কাছেই পাওয়া যাচ্ছে উচ্চ প্রযুক্তির বিভিন্ন কোম্পানির মোবাইল হ্যান্ডসেট। আর কম দামি এসব মোবাইল হ্যান্ডসেটের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্রেতাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। তারা অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে অশ্লীল ভিডিওচিত্র কপি করে দেয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে অল্প বয়সেই শিশুরা যৌন আচরণে প্রলুব্ধ হচ্ছে এবং সুস্থ বিনোদন থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। মোবাইলফোন হাতে পেয়ে অবুঝ মেয়েরা স্বল্প সময়ের কথোপকথনে অপরিচিতদের সাথে জড়িয়ে পড়ছে প্রেমসম্পর্কে। যুবকের সাথে দেখা করতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আর প্রতারিত হয়ে আবেগবশত ওই কিশোরীরা কখনও বা বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। যা কারোই কাম্য নয়।

দামুড়হুদা পাইলট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী মোহনা ইসলাম মিতু, আঁখি আলমগীর ও সানজিদা আক্তার এক সুরে বলে উঠলো, না না না । ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মোবাইলফোন ব্যবহার করতে দেয়া যাবে না। কারণ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের এখনও পর্যন্ত এগুলো ব্যবহারের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দেয়নি।

দামুড়হুদা মডেল পাইলট হাইস্কুলের মেধাবী ছাত্র এসএসসি পরীক্ষার্থী ইকবাল আব্দুল্লাহ একই সুরে সুর মিলিয়ে বলেন, ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মোবাইলফোন ব্যবহার করতে দেয়া ঠিক না। কারণ ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সে ছেলেমেয়েদের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। তাই বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক ভুলই বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া শ্রেণিকক্ষে বা কোচিঙে পড়তে গিয়ে মোবাইলফোনের ক্যামেরা দিয়ে ছেলে শিক্ষার্থীরা তুলছে সহপাঠী মেয়ে শিক্ষার্থীদের ছবি। পরে ওই ছবি অপব্যবহার করে ছড়িয়ে দিচ্ছে অন্য সহপাঠীদের মোবাইলফোনে এবং ইন্টারনেটে। তাছাড়া এ বয়সে যদি মোবাইলফোন ব্যবহার করে তাহলে পড়াশোনার প্রতি বেশি মনোযোগ না দিয়ে ওই দিকেই ঝুঁকে পড়বে।

এ বিষয়ে ওই স্কুলের দশম শ্রেণির আর এক মেধাবী ছাত্র তানভীর আহম্মেদ খাঁন কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে বলে, তথ্য প্রযুক্তির যুগে যোগাযোগের জন্য মোবাইলফোন বা ইন্টানেট ব্যবহার করা যেতেই পারে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এর ব্যবহার এক্কেবারে যে নেই তা সঠিক নয়। তবে অপব্যবহার না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। অপব্যবহার যে শুধু শিশু-কিশোররাই করছে তা কিন্তু না। বড়দের ক্ষেত্রেও হচ্ছে এর যথেষ্ট অপব্যবহার। মোবাইলফোনে পরকীয়া প্রেমের ঘটনা খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে। সুতারাং অপব্যবহার রোধে প্রতিটি ক্যাফেতে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ওপর সরকারিভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা থাকতে হবে। শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। বড়দের ক্ষেত্রেও আইনি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

দামুড়হুদা বাজারের মোবাইল ও সিম বিক্রেতা স্বপন টেলিকমের মালিক রিপন মিয়া বলেন, আমার জানামতে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া সিম বিক্রি এখন আর হচ্ছে না। তবে কিছু দোকানি করলে করতেও পারেন। অপ্রাপ্ত বয়স্করা সিম কিনতে এসে কখনো কখনো মা-বাবার পরিচয়পত্র ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে বাবা-মাকে অবশ্যই সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে।