স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের পর শুধু হত্যাই করা হয়নি লাশের ওপরও চালানো হয়েছে পাশবিক নির্যাতন

মৃতদেহ আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সামনে নেয়া হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ সহপাঠীরা : ছত্রপাড়ায় দাফন

 

জিনে মেরেছে প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে মামলায় অনাগ্রহ দেখা দিলেও হত্যার আলামত দেখে ঘাতকদের বিচার চাইলেন পিতা : আজ মানববন্ধন

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো/স্টাফ রিপোর্টার: স্কুলছাত্রী তাহেরা খাতুনকে ধর্ষণের পর শুধু হত্যাই করা হয়নি, হত্যার পর চালানো হয়েছে পাশবিক নির্যাতন। ডান হাতে কেটে লেখা হয়েছে ‘লাভ ইউ’। কাঁচ বা ধারালো কিছু দিয়ে চিরে দেয়া হয়েছে বুক। ধর্ষণের সময় টেনেহেঁচড়ে যেন খাবলে খেয়েছে মানুষরূপী নরপশুর দল। আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী তাহেরা খাতুনের মৃতদেহে দগদগে আঘাতের দাগ দেখে অভিজ্ঞজনেরা এরকমই মন্তব্য করে বলেছেন, ধর্ষক খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তাহেরার আত্মাও বোধ করি শান্তি পাবে না।

তাহেরা খাতুন আত্মহত্যা করেনি। হত্যার আলামত স্পষ্ট। হত্যার আগে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণেরও আলামত মিলেছে। হত্যার পর লাশের গলায় রশি বেঁধে ঝুলিয়ে রেখেই ঘাতকচক্র ক্ষান্ত হয়নি, হত্যাকাণ্ড ঢাকতে তারা কৌশলে জিনে মেরেছে বলেও প্রচার চালিয়েছে। গতকাল স্কুলছাত্রী তাহেরা খাতুনের মৃতদেহ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়। শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। বুকে ও হাতে ধারালো কিছু দিয়ে কেটে দেয়ার আগে ধস্তাধস্তির কারণে দু হাতেই কালো দাগ ফুটে উঠেছে। সূত্র এরকমই তথ্য দিতে গিয়ে বলেছে, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া লাশ পাইনি।

গতকাল মঙ্গলবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হত্যা মামলা রুজু হয়নি। তাহেরা খাতুনের পিতা আলমডাঙ্গা ছত্রপাড়ার শাজাহান আলী ঘাতকচক্রের সহযোগীদের জিনে হত্যার অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হলে মামলায় গতকাল অনাগ্রহ দেখালেও শেষে তিনি মামলা করে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাইবেন বলে জানিয়েছেন। আজ বুধবার মামলা হতে পারে। অপরদিকে আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ বলেছে, নিয়ম অনুযায়ী অপমৃত্যু মামলা রুজু করে লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্ত করানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে তার নিজ গ্রাম ছত্রপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হয়। আলমডাঙ্গায় তাহেরা হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে স্কুল ছাত্রছাত্রীসহ সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। এরই অংশ হিসেবে আজ বুধবার আলমডাঙ্গায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হবে। অপরদিকে হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন কয়েকজন আত্মগোপন করেছে। এর মধ্যে বাড়ির মালিকের ছেলে বাচ্চুসহ এলাকারই কয়েক কলেজছাত্র। কলেজছাত্রদের একজন মাঝে মাঝেই তাহেরা খাতুনকে উত্ত্যক্ত করতো বলে তাহেরার কয়েক বান্ধবী জানিয়েছে।

জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার ছত্রপাড়ার শাজাহান আলীর বড় মেয়ে তাহেরা খাতুন। মেয়ের লেখাপড়ার জন্যই শাজাহান আলী সপরিবারে আলমডাঙ্গা আনন্দধামের আব্দুল কাদেরের বাড়ির দুটি ঘর ভাড়ায় নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন। গতপরশু সকাল ১০টার দিকে তাহেরার নানি খাইরুন্নেছা তাহেরাকে ওই বাড়িতে একা রেখে অপর এক মেয়ের বাড়ি যান। দুপুরে ফিরে দরজা ধাক্কাধাক্কি করে সাড়া না পেয়ে ওই মেয়ের বাড়ি ফিরে যান। এর দু ঘণ্টার মাথায় বেলা দুটোর দিকে ফোনে তাহেরার পিতাকে জানানো হয়, তোমার মেয়ে গলায় ফাঁস দিয়েছে। অথচ তাহেরার নানি পরে সেখানে হাজির হয়ে দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। ঘরের ভেতরে তখন ঝুলছিলো লাশ। স্থানীয়দের কেউ কেউ এ ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে জিনে মেরেছে বলে অপপ্রচার চালাতে থাকে। খবর পেয়ে আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। রাতে পুলিশ হেফাজতেই রাখা হয়। গতকাল চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালমর্গে ময়নাতদন্ত করা হয়। দুপুরে লাশ নেয়া হয় আলমডাঙ্গায়। বিকেল ৩টার দিকে আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যামিক বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে মৃতদেহ নেয়া হলে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ সহপাঠীরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। তাহেরাকে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাতে থাকেন তারা। কিছুতেই থামানো যাচ্ছিলো না প্রধান শিক্ষিকার কান্না। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তাহেরাকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে এ বর্বর হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে আজ বুধবার দুপুরে হাইরোডে মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ছাড়াও সে মানববন্ধনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে পৌরসভাধীন সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ ও মহিলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরাও এ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গতকাল দিনভর আনন্দধাম এলাকায় প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিলো তাহেরা হত্যাকাণ্ড। মৃতদেহ দেখে অনেকেই মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, তাহেরার ডান হাতের তালুতে ‘আই লাভ ইউ’ লেখা। লেখা হয়েছে সম্ভবত হত্যার পর। ওটা যে নিজের লেখা নয় তা নিশ্চিত। কেননা, তাহেরা লিখতো ডান হাত দিয়ে। তার ডান হাতেই লেখা। বাম হাত দিয়ে লেখা হলে তা উল্টো হতো না। অন্য কেউ লিখেছে বলেই ডান হাতে এবং লেখা উল্টো দিকে। ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তাহেরার নানি খাইরুন্নেছা বলেছেন, সকাল ১০টার দিকে তিনি তাহেরাকে একা রেখে নিকটবর্তী আরেক মেয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। দুপুর প্রায় পৌনে ২টার দিকে তাহেরার জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে ফিরে দেখি দরজা বন্ধ। দরজা খুলতে না পেরে ফেরত যান তিনি। পরে ফিরে দরজা ধাক্কা দিতেই তা খুলে যায়। ঘরের দরজা যখন বন্ধ ছিলো তখন ফুসফাস শব্দ শুনলেও তিনি নীরব ছিলেন।

এদিকে এ বর্বরোচিত ঘটনায় জড়িত সন্দেহের তালিকায় আপাতত ৩/ ৪ জন যুবকের নাম উঠে আসছে। সর্বাগ্রে বাড়িমালিক আব্দুল কাদেরের ছেলে মাসুদ রানা বাচ্চুর নাম এলাকাবাসীর অনেকে উচ্চারণ করছেন। ঘটনার পর বাচ্চুকে রাত পর্যন্ত বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সে ব্যাংকে কাজ করতে গিয়েছিলো বলে তার পিতা দাবি করেন। তবে প্রতিবেশীদের অনেকের দাবি- বাচ্চু ঘটনার পর থেকে ঘরে শুয়ে ছিলো। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে তাকে বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে অনেকেই দেখেছে বলে দাবি করেছেন। এছাড়া আলোচনায় প্রতিবেশী আরও দু কলেজপড়ুয়া যুবকের নাম উঠে আসছে। তাদের একজন জানালা দিয়ে মাঝে মধ্যে তাহেরাকে উত্ত্যক্ত করতো বলে তাহেরার বান্ধবীদের অনেকের দাবি।

জিনে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এমন অপপ্রচারে বিশ্বাস স্থাপন করে তাহেরার পিতা প্রথমে মামলা করতে কিছুতেই সম্মত না হলেও সত্য অনুধাবন করতে পেরে বর্তমানে মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আজ বুধবার তিনি আলমডাঙ্গা থানায় এজাহার দায়ের করবেন বলে তার নিকটজনেরা জানিয়েছেন।