ধর্ষণ হত্যা রোধে উদাসীনতা ডেকে আনবে সর্বনাশ

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় এসএসসি পরীক্ষার্থী তাহেরা খাতুনের লাশ উদ্ধারের পর যতোই সময় গড়িয়েছে, ততোই স্পষ্ট হয়েছে হত্যার বিষয়টি। ধর্ষণের আলামতও মিলেছে। অথচ ধর্ষকসহ ঘাতকচক্র ধরা পড়েনি। অভিযোগ রয়েছে, লাশ উদ্ধারের সময় সন্দেহভাজনকে দেখা গেলেও ধরা হয়নি তাকে। যখন লাশ উদ্ধারে পুলিশ আপসহীন হয়ে ওঠে, তখন গাঢাকা দেয় সে। এতেই স্পষ্ট- ধর্ষক ও হত্যাকারীরা লাশের গলায় রশি বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টায় ছিলো। জিনে হত্যা করেছে বলেও প্রচার করতে ছাড়েনি তাদেরই কেউ কেউ। যদিও সফল হয়নি তারা।

ক’মাস আগে আলমডাঙ্গারই পল্লি হাড়োকান্দির এক শিশু হত্যার ঘটনা প্রথমে ধামাচাপা দেয়া হয়। বলা হয়, জিনে তাকে হত্যা করে গর্তের পানিতে ফেলে রেখেছে। পত্রপত্রিকায় যখন লেখালেখি শুরু হয়, তখন পুলিশেরই কেউ কেউ ঘটনাটি নিয়ে সাংবাদিকদের বাড়াবাড়ি বলে মন্তব্য করে। সন্দেহভাজন হত্যাকারী প্রকাশ্যে ঘুরতে থাকে। এক পর্যায়ে শিশুকন্যা হত্যা রহস্য উন্মোচনে গ্রামের সাধারণ মানুষ সোচ্চার হয়, শিশু কন্যার মা ও বোনেরাও সুষ্ঠু তদন্তের দাবি তোলে। শেষ পর্যন্ত মামলা হয়। কবর থেকে লাশ তুলে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। হত্যার আলামত মিলেছে। তবে ধর্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ফরেনসিক প্রতিবেদনের অপেক্ষায় বলে সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে। এ ঘটনার জের কাটতে না কাটতে আলমডাঙ্গা উপজেলা শহরের উপকণ্ঠ আনন্দধামপাড়ায় ঘটলো এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যা। এ হত্যাকাণ্ডও আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা চলে। এক পর্যায়ে জিনে মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে বলেও ঘাতকচক্রের কেউ কেউ প্রচার করতে থাকে। ভাগ্যিস পুলিশ জিনের ভয় পায়নি। লাশ উদ্ধার করে আইনানুগভাবে ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করেছে।

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন- এতো ধর্ষণ কেন? কেন এতো হত্যাকাণ্ড? যেকোনো মূল্যে ধর্ষণ রোধ করতে হবে। ধর্ষণ রোধে দরকার মূল কারণ অনুসন্ধান। অবশ্যই ধর্ষণের আড়ালে মাদক ও পর্নোছবিসহ কিছু কারণ লুকিয়ে রয়েছে। উত্তেজনার বশে ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে শেষে ফাঁস হওয়ার আশঙ্কায় হত্যা করে বসে। হত্যা করে অনেক সময় আত্মহত্যা বলে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার সুযোগ মেলে বলেই এ ধরনের হত্যার হীনপ্রবণতা ছড়ায় বা ছড়িয়েছে বললে ভুল বলা হয় না। মাদক, পর্নোছবি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেলফোন ইন্টারনেটে সহজলভ্য। ফলে উঠতি বয়সীদের অনেকেই বিপথগামী হচ্ছে। পূর্ণ বয়সীদের সকলেই যে পর্নোছবির ধকল সামলাতে পারছে তাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তা হলে উপায়? কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। যদি সমস্যা সমাধানে সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকে। পর্নোছবির ছড়াছড়ি রোধে সমাজের সাধারণ মানুষ অসহায়। বিটিসিএল যেহেতু দেশের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ করে, তা হলে ওর কর্তারা কেন ওইসব রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না?

অবশ্যই পর্নোছবির ছড়াছড়ি রোধে বাস্তবমুখি পদক্ষেপ দরকার। দরকার মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে সামাজিক আন্দোলন। পর্নোছবি ও মাদক সমাজের গভীরে ঢুকে যতোটা শক্ত বাসা বেঁধেছে, তা কি আদৌ উৎপাটন সম্ভব? অসম্ভব বলে দায় এড়ালে সমাজ যাবে রসাতলে। মেয়েরাই শুধু ধর্ষণের শিকার নয়, ছেলেদেরও নিপীড়নের শঙ্কা দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ফলে কোনো পরিবারই যে নিরাপদ নয়, তা সকলকেই উপলব্ধি করতে হবে। ধর্ষণ সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে। উদাসীনতা ডেকে আনবে সর্বনাশ। আর হত্যা প্রবণতা? রোধে দরকার সর্বক্ষেত্রে সমানভাবে আইন প্রয়োগ।

এসএসসি পরীক্ষার্থী তাহেরা খাতুনের পিতা-মাতা সমাজকে কখনোই ক্ষমা করবে? যে কৃষক দম্পতি তাদের কন্যাকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখে গ্রাম ছেড়ে আলমডাঙ্গা উপজেলা শহরে ভাড়ায় বসবাস করে আসছিলো। সেই কৃষক দম্পতি হারালো তাদের কন্যাকে। ওই কৃষক দম্পতি তো কন্যার উচ্চশিক্ষার জন্য নিজেরাসহ কন্যাকে নিয়ে ভাড়াবাড়িতে বসবাস করে আসছিলেন, অনেক কন্যার পিতা-মাতাই তো সমাজের ওপর ভরসা করে কন্যাকে শহরে রেখে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তাহেরা খাতুনের মতো পরিণতির শিকার কন্যার সংখ্যা বেড়ে গেলে নারীর অগ্রযাত্রা থমকে যাবে! মুখ থুবড়ে পড়বে জাতির। ফলে কোনোভাবেই তাহেরা খাতুন ধর্ষণ হত্যা ঘটনা খাটো করে দেখা উচিত হবে না। ধর্ষক ও হত্যাকারীদের ধরে দ্রুত আইনে সোপর্দ করতে হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে তাহেরা খাতুনদের নিরাপত্তা দুরস্ত, মানুষরূপী নরপশুরা ওদের খাবলে খাবলে খাবে।

পুনশ্চ: জাতি যেদিন বেগম রোকেয়ার স্মরণসভায় ব্যস্ত, সেদিনই ময়নাতদন্ত হলো তাহেরা খাতুনের।