পবিত্র আশুরা : ন্যায়ের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাই মুক্তি

 

আজ পবিত্র আশুরা। আরবি আশুরা শব্দের অর্থ দশ। ইসলামী বর্ষ পরিক্রমার প্রথম মাস মহররম। এ মাসের ১০ তারিখকে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) আশুরা নামে অভিহিত করেছেন। বিশ্ব ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এদিনে সংঘটিত হয়েছে। সেগুলো যুগে যুগে মুসলমানদের অস্তিত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে।

 

মুসলমানরা বিশ্বাস করে, আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন মহররমের দশ তারিখে। এ দিনেই তিনি তা ধ্বংস করবেন। এ দিনেই হযরত আদমের (আ.) সৃষ্টি, জান্নাতে প্রবেশ, পৃথিবীতে প্রেরণ ও আল্লাহ তায়ালার দরবারে তার তওবা কবুল হয়। এ পবিত্র দিনে হযরত ইদ্রিস (আ.) বেহেশতে গমন করেন, হজরত নূহের (আ.) তরি প্রবল তুফান ও প্রলয় থেকে রক্ষা পেয়ে তীরে ভিড়ে, দুরারোগ্য ব্যধি থেকে হযরত আইয়ুবের (আ.) মুক্তিলাভ ঘটে। এদিনে হযরত ইব্রাহিমের (আ.) জন্ম, নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তিলাভ, মহান আল্লাহর সাথে তুর পাহাড়ে হযরত মুসার (আ.) কথোপকথন, তাওরাত লাভ, সঙ্গীসাথীসহ নীল দরিয়া পার এবং ফেরাউন ও তার বাহিনীর নীল দরিয়ায় সলিল সমাধি ঘটে। হযরত ইউনূসের (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি, হযরত ঈসার (আ.) জন্ম ও সশরীরে ঊর্ধ্বগমন ইত্যাদি বহু ধর্মীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো আশুরাতেই। তাই এটি মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন।

হিজরি ৬১ সালের এদিনে ফোরাত নদীর তীরে ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে, তা সমগ্র মুসলিম জাহানকে শোকে-বেদনায় স্তব্ধ করে দিয়েছিলো। মহররম মাস এলেই কারবালার সেই বেদনাবিধুর স্মৃতিতে প্রত্যেক মুসলমানের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কারবালা প্রান্তরে নৃশংস ঘটনা যখন ঘটে, তখন মুসলিম জাহানে চরম অরাজকতা চলছিলো। ইসলামের চার খলিফার স্বর্ণযুগ তখন অতীত। মুয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদ তখন রাজতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর। প্রিয় নবীর (সা.) দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এ অন্যায় মেনে নিতে পারেননি। ন্যায় ও সত্যের পতাকা সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে সুদৃঢ় শপথ নিতে তিনি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সে যুদ্ধ ছিলো অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার। ইয়াজিদ যুদ্ধের সব রীতিনীতি ভেঙে হত্যা উৎসবে মেতে ওঠে। কারবালা প্রান্তরে পরিবার-পরিজন ও সহযোদ্ধাদের সাথে নির্মমভাবে শহীদ হন রাসূল দৌহিত্র। সত্যের পথে অসীম সাহসী বীর হযরত ইমাম হোসাইন (রা.) এবং তার স্বজন ও সহযোদ্ধারা মৃত্যু অবধারিত জেনেও আপসহীন যুদ্ধ করে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। ইয়াজিদ বাহিনী ফোরাতের তীর অবরুদ্ধ করে ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার সহযোদ্ধাদের দিনের পর দিন এক বিন্দু পানিও পান করতে না দিয়ে তাদের নিদারুণ কষ্ট দিয়েছে। পিপাসায় কাতর হয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু ইসলামের মহান শিক্ষা ঈমানের পথ থেকে তারা মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত হননি। আশুরার এ দিনটি মূলত মুসলমানদের জন্য কারবালার সেই দুঃসহ স্মৃতিই বহন করে আনে। এ শোকাবহ স্মৃতিকে মানসপটে রেখে ভাবগাম্ভীর্যের সাথে ইবাদত-বন্দেগির নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। মাতমের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি কিংবা উৎসবমুখর মিছিল কারবালার সেই আত্মত্যাগ ও আদর্শের সাথে মানায় না। ন্যায় প্রতিষ্ঠার কঠিন সংগ্রামে অসীম সাহসের সাথে আপসহীন লড়াই করে কীভাবে প্রয়োজনে আত্মবিসর্জন দিতে হয়, সে শিক্ষা আমরা লাভ করতে পারি কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনা থেকে।

 

লোভ ও হিংসার ব্যাপকতায় আজ বিশ্বের দেশে দেশে মানবতা হয়ে পড়ছে বিপন্ন। মুষ্টিমেয় মানুষের লোভের কাছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শান্তিতে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা দূরাস্ত অধিকার টুকুও ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। এ সময়ে কারবালার মহান আদর্শে আমরা উজ্জীবিত হতে পারি। ন্যায়ের প্রতি অবিচল নিষ্ঠাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে সব অন্যায় ও অশান্তি থেকে। পবিত্র আশুরায় তাই প্রার্থনা- সত্যের উজ্জ্বল আলোয় দূর হোক মিথ্যার কালিমা। পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পাক ন্যায় ও সত্য।