স্টাফ রিপোর্টার: বহুল আলোচিত সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল, ২০১৪ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে বিচারকদের অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ ১৯৭২ সালের সংবিধানের অবস্থায় প্রতিস্থাপিত হলো। অর্থাৎ সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ফিরে এলো জাতীয় সংসদের হাতে। প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ দলটির নয়জন এমপি বিলটির ওপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিলেও দলের উপস্থিত এমপিরা সবাই বিলের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন। গতকাল বুধবার সংসদে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারি জোট ১৪ দল, প্রধান বিরোধী দল জাপাসহ অন্যান্য ছোট বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের সমন্বিত সমর্থনের মধ্য দিয়ে এবং কোনোরকম বিরোধিতা ছাড়াই নির্বিঘ্নে বিলটি পাস হয়।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে মাগরিবের নামাজের বিরতির পর নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সন্ধ্যা ঠিক ৭টায় সংসদের অধিবেশন শুরু হয়। এর আগেই প্রায় কানায়-কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায় অধিবেশনকক্ষ। ৭টা ৩৭ মিনিটে স্পিকার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশকৃত আকারে সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল, ২০১৪ সংসদের বিবেচনার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করতে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হককে আহ্বান জানান। বিলটির ওপর আনা জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব এবং বিভিন্ন দফায় আনা সংশোধনী প্রস্তাবসমূহ কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যাওয়ার পর সংসদ সদস্যরা অধিবেশন কক্ষ থেকে বের হয়ে সংসদ লবিতে গিয়ে গোপন ব্যালটের স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিলের পক্ষে ভোট দেন। এরপর স্পিকার ভোটের ফলাফল ঘোষণা করেন। পরে আইনমন্ত্রী বিলটি পাসের প্রস্তাব করলে তা পাস হয়। এ সময় সরকারি ও বিরোধী দলের সবাই একযোগে টেবিল চাপড়ে নিজেদের সমর্থন জানান।
বিলটির ওপর সংশোধনী এনে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব আনেন ১৫ জন সংসদ সদস্য। তারা হলেন- বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ, জাপার জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, কাজী ফিরোজ রশীদ, এমএ হান্নান, ইয়াহইয়া চৌধুরী, বেগম রওশন আরা মান্নান, নূরুল ইসলাম মিলন ও পীর ফজলুর রহমান, জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) চেয়ারম্যান এসএম আবুল কালাম আজাদ এবং স্বতন্ত্র সদস্য- রুস্তম আলী ফরাজী, হাজি মোহাম্মদ সেলিম, তাহ্জীব আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল মতিন। আবুল কালাম আজাদ ছাড়া প্রত্যেকেই নিজ প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে বিলটিকে বিতর্কমুক্ত রাখতে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। তবে তাদের এ প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়।
কণ্ঠভোটে নাকচ হওয়ার আগে সদস্যদের জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, প্রস্তাবকারীদের অনেকের প্রশ্ন ছিল- এতে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে কিনা। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি, কোনো হস্তক্ষেপ হবে না। সংসদে দুই তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাব পাসের পরেই কেবল সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, বিলে বলা আছে, কেবলমাত্র প্রমাণিত গুরুতর অসদাচরণ ও বিচারকাজ করতে অসামর্থ্যের কারণেই একজন বিচারককে অপসারণ করা যাবে। একজন বিচারক অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। আমরা বলে থাকি, আল্লাহর পরেই বিচারক। সেই কারণে তার হাতের ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হোক, আমরা সেটির পক্ষে নই।
জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাবের পক্ষে এরশাদ তার বক্তব্যে বলেন, যদি বলি বিলটি সঠিক বা এতে যদি সমর্থন দিই- তাহলে বলা হবে আমরা বিরোধী দল নই। বিলটি না বুঝে এক বাক্যে মানি না, মানবো না বলে যদি সংসদের বাইরে গিয়ে আন্দোলন-হরতাল করি, গাড়ি ভাঙচুর করি, সংসদে গালিগালাজ করি, তাহলে হয়তো বলা হবে আমরা সত্যিকারের বিরোধী দল। কে কী বললেন, কী ভাবলেন- তা আমাদের ভাবার বিষয় নয়। আমরা নীতি-আদর্শের রাজনীতি করি। আমরা মনে করি বিলটি পাস হলে সংসদের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হবে। তিনি বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে বিলটি পাস হলে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ হবে কি-না? ক্ষমতা ছাড়ার পর আমার বিরুদ্ধে ৭৪টি মামলা হয়েছিলো। আমি তো ন্যায় বিচার পাইনি!
এরশাদের পর বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, বিচারকদের অপসারণে বিল পাসে তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে বলে কথা উঠেছে। সবার সাধে আরও বিশদ আলোচনা করে জনমত যাচাই করলে ভালো হতো। তাড়াহুড়ো করলে জনমনে সন্দেহ থাকবে। তিনি বলেন, ক্ষমতা থেকে যাওয়ার পর আমাদের যেভাবে হয়রানি করা হয়েছে তা আর কারও বেলায় হয়নি। একটি অন্যায়ের জন্য আমরা চার রকম শাস্তি পেয়েছি। এটা কী বিচার হলো? তাহলে আইন সবার জন্য সমান হলো কীভাবে? আমাদের বেলায় সেটি হলো না কেন? একটি জমি কিনে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিল্ডিং করায় আমাদের চার ধরনের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এখনও আমরা ন্যায় বিচার পাইনি। আমার প্রশ্ন, কেন পাইনি? রওশন আরও বলেন, বিচারকদের প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হলে দেশে আইনের শাসন ও সুশাসন থাকতে হবে।
জাপার জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, বিলটি আরও অনেক আগেই আনা উচিত ছিলো। সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পরিবর্তে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে আনা সংসদীয় গণতন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে কি-না। আমি মনে করি হবে না। তারপরেও অধিকতর গ্রহণযোগ্যতার জন্য জনমত যাচাই করা প্রয়োজন।
জাপার আরেক সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে আপত্তি নেই। তবে এত তাড়াহুড়ো কেন? গণতন্ত্র সমুন্নত রাখতে হলে স্বাধীন বিচার বিভাগ ও গণমাধ্যম থাকতে হবে। নইলে জনগণের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। এই সংশোধনী নিয়ে ভবিষ্যতে যেন কথা না ওঠে, সেজন্যই জনমত যাচাই দরকার।
জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, সংবিধান প্রণেতাদের যারা এখন এ সংশোধনীর বিরোধিতা করছেন, তারা কেন এ ভুল স্বীকার করেন না যে, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রেখে প্রধানমন্ত্রীর হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বিএনএফ চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, জনমত যাচাইয়ের জন্য এই সংসদই যথেষ্ঠ। তাছাড়া জনমত যাচাই এক জিনিস, আর বিরোধিতা আরেক জিনিস। সংবিধান প্রণেতাদের কেউ কেউ আজ কি করছেন সেটি বিবেচনার দাবি রাখে। ঝিনাইদহ-২ আসনের স্বতন্ত্র সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকী বলেন, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উত্স জনগণ। সংবিধান সংশোধনের পর বিচারকদের অপসারণে ভবিষ্যতে আইন হবে। এ নিয়ে জনমনে শঙ্কা-উদ্বেগ কাজ করছে। এই উদ্বেগ কাটাতে আইনের সাথে বিচারকদেরও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যাতে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে পারে। এছাড়া বিচারকদের আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযোগ দিতে হবে। স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, বিলটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ নিয়ে আইনবিদ এবং ’৭২ এর সংবিধান প্রণয়নের সঙ্গে যুক্তদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। কারণ বিলটি নিয়ে এরইমধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
গতকাল বুধবার হওয়ায় পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের পর দিনের কার্যসূচি অনুযায়ী প্রথম ত্রিশ মিনিট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রশ্নোত্তর চলে। এরপর মন্ত্রীদের প্রশ্নোত্তর টেবিলে উত্থাপিত বলে ঘোষণা দেন স্পিকার। দিনের কার্যসূচিতে থাকা কার্যপ্রণালী বিধি ৭১- এ আনা জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ নোটিসসমূহের কার্যক্রম স্পিকার স্থগিত করেন। এরপর সংবিধান সংশোধন বিল পাসের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
বিলের বিভিন্ন দফায় সংশোধনীর প্রস্তাবকারীদের বেশিরভাগই বিচারপতি অপসারণের সাথে নিয়োগের বিধিমালা প্রস্তাবিত আইনে যোগ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। ফিরোজ রশীদ তার সংশোধনীতে, বিচারপতিদের অসামর্থ্য ও অসদাচরণ প্রমাণের জন্য জুডিসিয়াল ইনভেস্টিগেশন কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। সংসদে উত্থাপিত বিলের প্রস্তাবনাতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাত থেকে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে যাওয়ার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা ছিলো।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিলের দীর্ঘ প্রস্তাবনা বাদ দেয়ার পাশাপাশি উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে কিছু পরিবর্তন এনেছে। সংসদে উত্থাপিত প্রস্তাবে, কোনো বিচারপতির অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণ আইন করে সংসদ নিয়ন্ত্রণ করার শর্ত রাখা হয়েছিলো। সংসদে উত্থাপিত বিলে বলা ছিল, … এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিবেন। সংসদীয় কমিটি এই দফা পরিবর্তন করে বলেছে, … সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন। এছাড়া উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে পরবির্তন এনে বলা হয়েছে, … বিলের ৩ দফার বিধান অনুযায়ী কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন। সুতরাং উক্ত আইনে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টে কোনো বিচারককে অপসারণের সুযোগ থাকিবে না। স্থায়ী কমিটির এসব সুপারিশসহ গতকাল বিলটি পাস হয়।
গত ৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সাতদিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ওইদিনই বিলটি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। ঠিক সাতদিনের মাথায়, গত রোকবার সংসদে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংসদীয় কমিটির সভাপতি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সংসদীয় কমিটি গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর মাত্র দুটি বৈঠকেই এ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে।
উল্লেখ্য, সংবিধানের সর্বশেষ সংশোধনী পাস হয়েছিলো ২০১১ সালের ৩০ জুন। এটি ছিলো পঞ্চদশ সংশোধনী। বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে ওই সংশোধনীর মাধ্যমে। সংসদে বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সেদিন বিলটি পাস হয়েছিলো।