গণজাগরণ মঞ্চে বিভক্তি : ইমরানকে মুখপাত্রের দায়িত্ব থেকে বাদ দিলো একাংশ

স্টাফ রিপোর্টার: নিজেদের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও সংগঠক দাবি করে ডা. ইমরান এইচ সরকারকে মুখপাত্রের দায়িত্ব থেকে গতকাল অব্যাহতি দিয়েছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবির আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত কয়েক ব্যক্তি। খবর শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে ডা. ইমরান বলেছেন, আমি যতোটুকু জেনেছি, যারা সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তারা আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার নেতৃত্বে করেছেন।

ডা. ইমরান বলেন, এর আগেও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বক্তব্য দিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের কোনো প্রয়োজন নেই। গণজাগরণ মঞ্চ কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এর মুখপাত্র নির্ধারণ করার দায়িত্বও কোনো একক রাজনৈতিক দলের নেই। এভাবে তারা গণজাগরণ মঞ্চকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে। গণজাগরণ মঞ্চ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে শুরু হয়েছিলো। এটা একটা নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্ম। সব যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রতিটি বিবেকবান নাগরিককে এ আন্দোলনে শরিক হওয়ার আহ্বান জানাই। অপরদিকে গণজাগরণ মঞ্চ ও ছাত্র সংগঠনের সূত্রগুলো জনিয়েছে, গণজাগরণ মঞ্চের সাম্প্রতিক ভাঙনের নেপথ্যে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের ইন্ধন রয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ওই ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা।

গতকাল শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে কর্মী ও সংগঠকবৃন্দ গণজাগরণ মঞ্চ শীর্ষক ব্যানারে গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে বর্তমান সংকট বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কামাল পাশা চৌধুরী, যিনি মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রকমান্ডের নেতা। তিনি ২৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সেলে কাজ করছেন বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক শিউলি বিনতে মহসিন, সোহেলী পারভিন মনি, হামিদা বেগম, উপকমিটির সদস্য এসএম এনামুল হক আবির, চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সহসম্পাদক রাশিদা হক কনিকা, গৌরব-৭১’র সভাপতি আজাদ আবুল কালাম, সাধারণ সম্পাদক এফএম শাহীন, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মের যুগ্ম সম্পাদক হাবিবুল্লাহ মিজবাহ, অপরাজেয় বাংলার সভাপতি এইচ রহমান নিলু প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলন আহ্বানকারী এ গ্রুপটির কয়েকজনের সাথে ৩ এপ্রিল গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী-সংগঠকদের সংঘর্ষ হয়। যার জের ধরে সেদিন গভীর রাতে শাহবাগ থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা এবং পরদিন ৪ এপ্রিল শাহবাগে ডা. ইমরান, লাকী আক্তার, মাহমুদুল হক মুন্সীসহ মঞ্চের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। একই ব্যানারে ৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলন করে ডা. ইমরানকে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। সেই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন এফএম শাহীন।

গতকাল শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিতর্কিত হয়ে পড়ার কারণে ডা. ইমরান এইচ সরকারকে সাময়িকভাবে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্রের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো। এই মুহূর্ত থেকে তার কোনো বক্তব্য ও কর্মসূচি গণজাগরণ মঞ্চের বক্তব্য ও কর্মসূচি বলে বিবেচিত হবে না। এখন থেকে পাঁচ সদস্যের একটি প্যানেল মঞ্চের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করবে, যাদের নাম অচিরেই জানানো হবে।

ডা. ইমরানকে কিভাবে অব্যাহতি দেয়া হলো জানতে চাওয়া হলে কামাল পাশা বলেন, তিনি যেভাবে মুখপাত্র হয়েছিলেন; সেভাবেই অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। শুরু থেকেই আমরা ছিলাম। শুরুর দিকে বিভিন্ন মিডিয়াতে আমরা ইন্টারভিউ দিয়েছি। পরে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য একজনকে কথা বলতে দিতাম। ডা. ইমরানকে মুখপাত্র নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত এএস কামারুজ্জামান বলেন, আমাদের মধ্যে যাতে শৃঙ্খলা ভঙ্গ না হয়, এজন্য সবাই মিলে একজনকে মিডিয়ার সামনে কথা বলার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তবে কথা ছিলো সব সিদ্ধান্ত সবার সাথে আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। পরে ডা. ইমরান কারও সাথে কথা না বলে নিজের একক সিদ্ধান্তে বিভিন্ন ব্যাপারে বক্তব্য রাখতেন এবং কর্মসূচি দিতেন।

ভাঙনের নেপথ্যে?: জানা গেছে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চের রোডমার্চ, নির্বাচন নিয়ে ডা. ইমরানের মন্তব্য, ঘরোয়া আলোচনায় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ডা. ইমরানের বক্তব্য, লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীতের জন্য ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে অর্থ নেয়ার সমালোচনা আমলে নেয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। এ সময় ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুক ও ব্লগে ডা. ইমরান এইচ সরকার ও গণজাগরণ মঞ্চের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা শুরু করেন।

ইতোমধ্যে ছাত্রলীগ-সমর্থক হিসেবে পরিচিত মঞ্চেরই একটি অংশের সাথে ডা. ইমরানের বিরোধ জোরালো হয়। ছাত্রলীগ গত বছর গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন থেকে সরে আসার পর মঞ্চের একটি অংশ গৌরব ৭১ নাম নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। এ অংশটিই মূলত ছাত্রলীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিত। গত বছরের ২ আগস্ট গণজাগরণ মঞ্চের আলোকচিত্র প্রদর্শনী চলাকালেই তারা জাতীয় জাদুঘরের সামনে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে। ওই সময় ডা. ইমরান এইচ সরকার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এ কর্মসূচি গণজাগরণ মঞ্চের নয়। সাধারণত যে জায়গায় গণজাগরণ মঞ্চ অনুষ্ঠান করে, সেই জায়গায় গৌরব ৭১’র নামে মঞ্চ তৈরি করা হলে এদের সাথেই ৩ এপ্রিল রাতে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের দু দফা মারামারির ঘটনা ঘটে। এই অংশটি ৪ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ডা. ইমরানকে শাহবাগে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ছাত্রমৈত্রী, ছাত্রলীগ (জাসদ), ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র সমিতি ও ছাত্র ঐক্য ফোরাম যৌথভাবে আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করে তাদের ডা. ইমরানবিরোধী অবস্থান পরিষ্কার করে। এর মধ্যে প্রথম চারটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক চারটি দলের ছাত্রসংগঠন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, ছাত্রলীগ নেতাদের প্ররোচনায় পাঁচ ছাত্র সংগঠনের ওই সংবাদ সম্মেলনটির আয়োজন করা হয়।

অবশ্য ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম গণজাগরণ মঞ্চের ভাঙন সংক্রান্ত ঘটনাপ্রবাহের সাথে ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক নেই উল্লেখ করে বলেছেন, ছাত্রলীগের কথা যখন মঞ্চ রাখেনি, তখন সাংগঠনিক কারণে তারা নিজেদের মঞ্চ থেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আর যখন ইমরান এইচ সরকার হামলার জন্য ছাত্রলীগ-যুবলীগকে দায়ী করেন, তখন অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য ছাত্রলীগ তাদের বক্তব্য দিয়েছে। মঞ্চের বিরোধ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে ছাত্রলীগ কোনোভাবে জড়িত নয়।

ওই সংবাদ সম্মেলনে গণজাগরণ মঞ্চকে ব্যবহার করে ইমরান এইচ সরকারের রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টার দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়, কেউ যদি ভিন্ন কোনো উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন দেখে থাকেন, তবে গণজাগরণ মঞ্চের ভেতরে থেকে নয়, বরং মঞ্চ থেকে বাইরে গিয়ে সেই স্বপ্ন তাকে দেখতে হবে।
আলাদা দল গঠনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডা. ইমরান এইচ সরকার বলেন, দল গঠনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ভবিষ্যতের ব্যাপার বলা কঠিন। সত্যিকারভাবে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে এমন সব শক্তিকে সাথে নিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চান। ইতোমধ্যে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মঞ্চ একটি স্বাতন্ত্র্য অবস্থান তৈরি করেছে। এ অবস্থানকে কেউ কেউ নিজেদের জন্য হুমকি মনে করছেন।