পাম চাষ : গ্রিন বাংলাদেশের প্রতারণার ফাঁদে সর্বস্বান্ত মেহেরপুরের চাষিরা

 

মহাসিন আলী মেহেরপুর: পর্যাপ্ত ফলন না হওয়ায় এবং তেল উৎপাদনের ব্যবস্থা না থাকায় মেহেরপুরের চাষিদের গলার কাঁটা হয়ে বিধেছে পাম গাছ। দীর্ঘ ৮ বছর পরিচর্যার পরও পাম গাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল না আসায় এবং তেল উৎপাদনের মাধ্যম না থাকায় এ জেলার ক্ষতিগ্রস্ত পামচাষিরা হতাশার সাগরে ভাসছেন। কোনো কূল কিনারা না পেয়ে শেষ মুহুর্তে তারা বিপুল পরিমাণ লোকসান আর ব্যাংক ঋণের বোঝা মাথায় রেখে পাম গাছ কেটে সেখানে অন্য ফসল চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে ‘গ্রিন বাংলাদেশ’ নামের একটি এনজিও মেহেরপুর জেলাসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পাম গাছের চারা বিক্রি করতে থাকেন। লাভজনক ফসল ও চাষের সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে চড়ামূল্যে চারা কিনে মেহেরপুরের কয়েক শত চাষি ফসলী জমিতে পাম বাগান গড়ে তোলেন। বাড়ির আঙ্গিনাসহ পতিত জমিতেও পাম গাছ লাগাতে থাকেন আগ্রহীরা। হিসেব অনুযায়ী জেলায় ছোট বড় ১২৫ টি বাগান করা হয় এবং যেখানে প্রায় ১২ হাজার পাম গাছ রয়েছে।

ভূক্তভোগী চাষিরা জানান, ২০১১ সালের মার্চ মাসের দিকে ওই এনজিও হটাৎ কার্যক্রম গুটিয়ে কর্মকর্তারা আত্মগোপন করেন। বিপাকে পড়েন এ জেলার পাম চাষিরা। গাছে ফল ধরা শুরু হলেও তা ঝরে পড়ছিলো। আবার দুয়েকটি ক্ষেতে ফল আসলেও তা বিক্রি ও তেল তৈরির কোনো উৎস না থাকায় চরম হতাশায় ভুগছিলেন চাষিরা। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কেউ কেউ পাম গাছ কেটে অন্য ফসল চাষ করতে আগ্রহী হয়ে উঠেন।

ভূক্তভোগীরা আরও জানান, চাষিদের এই দুঃসময়ের কাণ্ডারি হয়ে হাজির হন গাজিপুর এগ্রিকালচার ইনস্টিটিউট থেকে কৃষি ডিপ্লোমা পাশ করা মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের সুরজ আলী। সুরুজ আলীর সাথে যোগ দেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকজন কৃষি ডিপ্লেমাধারী যুবক ও ব্যবসায়ী। এদের সাথে ছিলেন অবসারপ্রাপ্ত কয়েকজন কৃষি কর্মকর্তা। বোটানিক এগ্রো লিমিটেডের নামে একটি ফার্ম গঠন করেন তারা। যার প্রধান কার্যালয় ছিলো মেহেরপুর কলেজ রোডে। তারা মিথ্যা আশার আলো দেখাতে থাকেন এ জেলার পামচাষিদের।

তারা পামচাষিদের আশ্বাস দিয়ে জানান, মেহেরপুরের মাটি ও আবহাওয়া পাম চাষের উপযোগী। বিশ্বের বৃহৎ পাম উৎপাদনশীল দেশ মালয়েশিয়া ও অষ্টলিয়া থেকে পাম চাষের অতীব প্রয়োজনীয় হরমন ও কীটনাশক আমদানি করা হবে। তারা আরও আশ্বাস দেন পামচাষের প্রয়োজনীয় কীটনাশক, হরমান, সার ও তেল উৎপাদন কারখানা মিলিয়ে প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে বোটানিক এগ্রো লিমিটেড। সময়ের প্রয়োজনে এই বিনিয়োগ আরও বাড়াবেন বলে আশ্বাস দেন এর কর্মকর্তারা। গাছ কাটতে নিরুসাহিত করে তারা ২০১২ সালের নভেম্বর মাস থেকে ঢাকার সানটেক এজেন্সিস অ্যান্ড সার্ভিসেস লি. এর প্রকৌশলী আমজাদ হোসেন ও ব্রয়লার এক্সপার্ট হাসান আলীর তত্বাবধানে যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ শুরু করেন। জার্মানের একজন প্রকৌশলীর সহযোগিতায় তারা তৈরি করেন পাম তেল উৎপাদন মেশিন। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে মেহেরপুর বিসিক শিল্প নগরীতে এর যন্ত্রপাতি স্থাপন করেন তারা। বীজ ও খোসা আলাদা কম্প্রেসার মেশিনে চেপে তেল বের করেন। বোটানিক এগ্রোর কর্মকর্তারা চাষিদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ক্ষেত থেকে ফল সংগ্রহ করে তেল উৎপাদন করে দেখাতে থাকেন। নিজেদের লাভের আশায় চাষিদের মাঝে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনে মাঝপথে তারা আবারও পাম চাষে চাষিদের মনোনিবেশ করেন। পাম গাছ না কেটে তারা চাষিদের পরিচর্যার পরামর্শ দেন। তার পরও কারখানাটি পুর্ণাঙ্গরূপে চালু হয়নি পর্যাপ্ত ফল অভাবে। আবারও পালিয়ে যান বোটানিক এগ্রো লিমিটেড নামের ফার্মটি। সময়ের দীর্ঘসূত্রিতায় লাখ লাখ থেকে কোটি কোটি টাকার লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে সর্বশান্ত হন এলাকার চাষিরা। মিথ্যায় পরিণত হয় সবুজ গাছে তরল সোনা, বদলে দেবে বাংলাদেশ নামের কাহিনী।

মেহেরপুর শহরের স্টেডিয়ামপাড়ার রুহুল আমীন জানান, গ্রীণ বাংলাদেশ নামের একটি এনজিওর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে তিনি আমদহ গ্রামের মাঠে তার ১৫ বিঘা জমিতে পাম বাগান তৈরি করেন। প্রতিটি চারা কিনেছিলেন ৬শ টাকা দামে। এরপর লাভের আশায় চাষ ও পরিচর্যা খরচ করতে থাকেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য তার। বিগত সময়ে তার গাছে তেমন ফল আসেনি। আর সামান্য ফল আসলেও তা বিক্রি বা তৈল তৈরি করতে না পারায় বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হন। তিনি বলেন, পাম চাষ শুরু থেকে লাভ তো দূরের কথা এতে তার প্রায় দেড় কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এখনও তার ক্ষেত থেকে কেটে ফেলা গাছের গোড়াসহ তুলে ফেলতে দেড় লাখ টাকা খরচ হবে।

জেলার গাংনী উপজেলার গাড়াবাড়িয়া গ্রামের চাষি হাজী ইছাহক আলীর দুই বিঘা জমিতে ৮৫টি পাম গাছ রয়েছে। সুরুজ ও তার টিমের তত্ত্বাবধানে ক্ষেতে উৎপন্ন ৫০ কেজি ফল শুরুর দিকে কারখানায় নিয়ে তেল তৈরি করা হয়। পরে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ায় তিনি গত ৮ বছরে তার কয়েক লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে।

মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের সুবাহ সামাজিক উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মঈনুল আলম বুলবুল বলেন, মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সাবেক উপ-পরিচালক শেখ ইখতেখার হোসেন সে সময় চাষিদের পাম চাষে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি বলেছিলেন তেল উৎপাদন কারখানাটি পুর্ণাঙ্গরূপে চালু হলে এ অঞ্চলের কৃষকসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ প্রভাব পড়বে। তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বুলবুল নিজেও ময়মনসিংহ থেকে ৩৫০ টাকা দরে এক হাজার টি পাম চারা সংগ্রহ করে চাষ করেন। তিনি এ থেকে কোন সুফল পাননি। বরং তিনি ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।

মেহেরপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা একেএম কামরুজ্জামান জানান, তার জানামতে মেহেরপুরের কোনো চাষি কৃষি বিভাগের পরামর্শ ছাড়ায় অধিক লাভের প্রলোভনে পড়ে পাম চাষ করেছেন। মেহেরপুরের মাটি পাম উৎপাদনের উপযোগি না, তদুপরি পাম ফল থেকে তৈল উৎপাদনের ব্যবস্থা না থাকায় এ চাষে চাষিদের ঝুঁকে পড়া উচিত হয়নি। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গ্রীন বাংলাদেশ নামের সংস্থাটির নামে মামলা করতে চাষিদের পরামর্শ দেন তিনি।