যক্ষ্মা রোগীদের নিবিড় সেবা দিয়ে প্রশংসিত চায়না খাতুন

রাজীব হাসান কচি: সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, কিন্তু তিনি কোনোদিন ওষুধ খাওয়াতে ভোলেন না যক্ষ্মারোগীদের। প্রতিদিন সকাল ৬টার আগেই ওষুধ, পানির জাগ ও গ্লাস নিয়ে বসেন তার খুপড়ি ঘরের বারান্দায়। তিনি চুয়ায়াডাঙ্গা সদর উপজেলার শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়নের হানুরবারাদী গ্রামের শ্রমিক আব্দুল মজিদের স্ত্রী চায়না খাতুন। ব্র্যাকের এ স্বাস্থ্য সেবিকা গত ৫ বছরে ১৫ জন যক্ষ্মারোগীকে সুস্থ করে তুলেছেন, বর্তমানে তার কাছে আরো ৫ জন ওষুধ খাচ্ছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হানুরবারাদী গ্রামের গৃহিনী আফরোজা, নিলুফা খাতুন, হালিমা খাতুন, ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি আবুল হোসেন ও কৃষক সাদ্দাম মালিতা একে একে চায়না খাতুনের বাড়িতে এলেন। এ সময় ঘরের বারান্দায় বসে থাকা চায়না খাতুন বাড়ির উঠোনে রাখা চেয়ারে একেক জনকে বসিয়ে পরম যত্নে ওষুধ খাওয়ালেন। এখানে কথা হয়, ইউনিয়ন ব্র্যাকের কর্মসূচি সংগঠক মতিয়ারুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, এখানে ওষুধ সেবনকারী ৫ জনই যক্ষ্মারোগী। ব্র্যাকের স্বাস্থ্য সেবিকা চায়না খাতুন প্রতিদিন সকালে ডট (ডাইরেক্ট অবজার্ভ ট্রিটমেন্ট) পদ্ধতিতে ওষুধ সেবন করিয়ে আসছেন। তার নিবিড় যত্নশীল সেবা এলাকা ও ব্র্যাকে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।

হতদরিদ্র ৩ সন্তানের জননী চায়না খাতুন বলেন, স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে গত ৫ বছর ধরে এ সেবা দিয়ে আসছি। প্রথম দিকে গ্রামের অনেকেই এ বাড়ির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন। তারা ভাবতেন যক্ষ্মা ছোঁয়াচে রোগ। এখন তাদের মন থেকে সেই ধারণা পাল্টেছে। তাকে এ ভালো কাজের জন্য এখন সবাই উৎসাহ জোগায়। কোনো বিনিময় নয়। ৬ থেকে ৮ মাস ওষুধ খাওয়ার পর যখন কোনো যক্ষ্মা রোগী এসে বলেন, আমি পুরোপুরি সুস্থ, তখন মনে হয় পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার মোট জনসংখ্যা ১২ লাখ ২৯ হাজার ১৫৬ জন। এ জেলার ৪টি উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরএলাকায় যক্ষ্মা নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ ও ব্র্যাক। সরকারি স্বাস্থ্য সহকারীর পাশাপাশি ব্র্যাক তার ৬০ জন স্বাস্থ্যকর্মী ও ৮৯৬ জন স্বাস্থ্য সেবিকার মাধ্যমে ২০৮টি কেন্দ্রে রোগীর কফ সংগ্রহ করে ৯টি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে। একই সাথে ডট পদ্ধতিতে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছে। শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকায় ডট পদ্ধতি চালু করা হয়নি। তারপরও কমছে না আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বরং প্রচার না থাকায় প্রতি বছর চুয়াডাঙ্গা জেলায় যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত যক্ষ্মা চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন ৮ হাজার ৭৭৮ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৭ হাজার ৯৮৬ জন। মারা গেছেন ৩১৪ জন। বর্তমান ২০১৫ সালের মে মাস পর্যন্ত আক্রান্ত ৯১৬ জন রোগী ডট পদ্ধতিতে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। সরকারিভাবে রোগটি নিরাময়ে ওষুধসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হলেও বাস্তবে তার সুফল মিলছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্ত রোগীর অজ্ঞতা ও সঠিকভাবে ওষুধের কোর্স শেষ না করার কারণে কমছে না আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। চুয়াডাঙ্গায় কয়েকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও যক্ষ্মা ধরা পড়েনি এমন রোগীর সন্ধানও পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ডিঙ্গেদহ গ্রামের সাইদুল ইসলামের মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী চারমিন খাতুন ও আকন্দবাড়িয়া গ্রামের মৃত কোকিল মণ্ডলের ছেলে হাজি মো. আবুল অন্যতম। আবার পাওয়া গেলো ওষুধ খেয়ে প্রথমে যক্ষ্মা নিরাময় হলেও কয়েক মাস পর আবারও আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সদর উপজেলার খেজুরা গ্রামের মিশনারি পাড়ার প্রিয় কুমার সরকার নামে এক রোগীও। নিয়মিত ওষুধ সেবন না করে এমডিআর (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্স) বা ঔষধ প্রতিরোধক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার হাসনহাটি গ্রামের আয়াত আলীর ছেলে শিপন ও দামুড়হুদা উপজেলার আজিমপুর গ্রামের মৃত সোবান আলীর ছেলে রবিউল।

ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির সদর উপজেলার সিনিয়র ম্যানেজার এএম মিজানুর রহমান বলেন, জেলা পর্যায়ে হাসপাতাল ছাড়াও উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি হাসপাতাল, ব্র্যাকের ডট সেন্টারে নিয়মিত কফ পরীক্ষা করা হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য সেবিকারা ডট সেন্টারে বা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওষুধ সেবন করিয়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করছেন। চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম বলেন, চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকায় ডট সেন্টার চালুর জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে যক্ষ্মা বিষয়ক বিভিন্ন সভা সেমিনারে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।