মানব পাচারের মূল নায়ক আরাকানের আনোয়ার

মাথাভাঙ্গা মনিটর: মানুষ যে এতো নিষ্ঠুর-নির্মম হতে পারে তা ভাবনায় ছিল না মানব পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের। সরল বিশ্বাসে ভাগ্যের উন্নয়নের আশায় সমুদ্রের ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় রওনা দিতেও কাপর্ণ্যবোধ করেননি নির্যাতিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও কিছু বাংলাদেশি। কিন্তু নিজ সম্প্রদায়ের যাকে বিশ্বাস করে সমুদ্র যাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন, তিনি যে এতো ভয়ংকর তা জানা ছিল না তাদের। শুধু কিছু টাকার জন্যে সাগরের মাঝপথ থেকে শুরু করে থাই জঙ্গলে একের পর এক মানুষ হত্যা করেছেন তিনি ও তার সহযোগীরা। হত্যাযজ্ঞ সিনেমা বা কল্প-কাহিনীকেও হার মানিয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞের মূল নায়ক মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মুন্ডের বাসিন্দা হাজী নানুর পুত্র মো. আনোয়ার।

এ পর্যন্ত প্রায় তিনশতাধিক মানবপাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিকে সমুদ্র ও থাই জঙ্গলে এই আনোয়ার সিন্ডিকেটের সদস্যরা হত্যা করেছে।  তবে শুধু হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি, নারীদের বন্দি রেখে অমানুষিক পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে দিনের পর দিন। গত ১ মে সংখলা জঙ্গলে গণকবরের সন্ধানের পরপরই মালয়েশিয়া সীমান্ত থেকে তাকে গ্রেফতার করে থাই পুলিশ। ইতিমধ্যে জঙ্গলে গণকবরে তার সম্পৃক্ততার বিষয় থাই পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন আনোয়ার। গণকবরে যাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তাদেরকে আনোয়ার ও তার সহযোগীরা জঙ্গলে এনেছিলেন বলে দাবি রোহিঙ্গাদের। থাই পুলিশের চলমান অভিযানে আনোয়ারের সহযোগীর হেফাজত থেকে এক কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়েছে।

হত্যার মূল হোতা আনোয়ার: মানব পাচারের শিকার রোহিঙ্গারা জানান, সংখলা ও সাগর পথে অসংখ্যা মানুষকে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা আনোয়ার ও তার সহযোগীরা। এই আনোয়ারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মানব পাচারের সাম্রাজ্য। গত ১ মের আগে মিয়ানমারের আরাকানের মুন্ডের (বর্তমানে সাউথ থাইল্যান্ডের বাসিন্দা) খইলা মিয়ার (রোহিঙ্গা) দুই ভাতিজাকে টাকার জন্য জঙ্গলে মেরে ফেলে আনোয়ার ও তার সহযোগীরা। বিষয়টি জানতে পেরে খইলা আনোয়ারকে ফোন করে উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময় করে। তখন আনোয়ার ফোনে তাকে বলে, টাকার প্রয়োজনে তোকেও হত্যা করবো। এরকম অসংখ্যা ব্যক্তিকে হত্যা করেছি। পরে আনোয়ারকে গ্রেফতার করা হলে খইলা বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর বেরিয়ে আসে আনোয়ারের জঙ্গলে মানুষ হত্যার একের পর এক ঘটনা।

আনোয়ারের মানব পাচার সিন্ডিকেট: ২০১২ সাল থেকে আনোয়ার সাগর পথে মানব পাচার কার্যক্রম শুরু করেন। মিয়ানমার প্রশাসন স্থানীয় রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করলে ২০১৩ সালে ব্যাপকহারে দেশত্যাগে বাধ্য হয় রোহিঙ্গারা। এতে মানব পাচারের পোয়াবারো হয় আনোয়ারের। স্থানীয় আরাকানের মুন্ডে নাফিজ বিনা পয়সায় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে মালয়েশিয়ায় যেতে উত্সাহ দেন। মালয়েশিয়ায় পৌঁছে কাজ করে টাকা দিলে হবে বলে রোহিঙ্গাদের আশ্বস্ত করা হয়। নাফিজের দায়িত্ব ছিল রোহিঙ্গা সংগ্রহ করে ছোট নৌকা ভরে মিয়ানমার নৌবাহিনীর সহায়তায় বঙ্গোপসাগরের জিনজিয়ায় নিয়ে যাওয়া। নাফিজের নেতৃত্বে আরাকানে রয়েছে একটি শক্তিশালী মানব পাচার সিন্ডিকেট। যারা অনেক সময় জোরপূর্বক সপরিবারে রোহিঙ্গাদের নৌকায় তুলে দিতো। পরে ছোট নৌকা থেকে তাদের নামিয়ে আগেই অবস্থান করা থাই বড়  নৌকা করে মানব পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের থাইল্যান্ড জঙ্গলে আনা হতো। জিনজিয়া থেকে থাই জঙ্গল এই পুরো অংশে আনোয়ার নিজে ও তার সহযোগী রশিদ, ইসমাইল, আলী, নুরুল হাকিম, হোসেন, মং সিং, সামার পোয়া প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতো। আনোয়ারের আরেক ভাই মোস্তফা মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী অংশ দেখভাল করতেন।

বড় বোট থেকে শুরু নির্যাতন: ছোট বোট থেকে বড় বোটে উঠানোর পর শুরু হতো নির্যাতন। স্বল্প টাকায় বিদেশ পাঠানোর কথা বলে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করতো আনোয়ার ও তার সহযোগীরা। বড় বোটে আনোয়ারের গংরা নিরীহ মানুষদের লোহার রড দিয়ে প্রহার করতো। তাদের সংখ্যা কম হলেও মানব পাচারের শিকারের মধ্যে যারা প্রতিবাদ বা টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানাতো তাদেরকে বোট থেকে ফেলে দেয়া হতো। এতে বোটে এক ধরনের আতংক সৃষ্টি হতো। এরপর বোট থেকে নামিয়ে জঙ্গলে চলতো চরম নির্যাতন। যারা টাকা দিতে পারতেন তারাই কেবল মালয়েশিয়ায় যেতে পারতেন।

জঙ্গলে আনোয়ার বাহিনীর ধর্ষণ: আনোয়ার গ্রেফতারের পরপরই তার সহযোগীদের ধরতে থাই প্রশাসন চিরুনি অভিযান শুরু করে। আনোয়ারের সহযোগী ইসমাইলের হেফাজত থেকে আরাকানের মুন্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ হোসেনের কন্যা লায়লাকে (১৬) উদ্ধার করে পুলিশ। লায়লা গত ৬ মাস ধরে নিখোঁজ ছিল। তাকে উদ্ধার করার পর থাই নিরাপত্তা হেফাজতে রাখা হয়েছে। থাই পুলিশ রোহিঙ্গা দোভাষীর সহায়তায় লায়লাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। লায়লা জানান, তাকে আনোয়ার বাহিনীর সদস্যরা জোর করে নৌকায় নিয়ে আসে। জঙ্গলে আনোয়ার, ইসমাইলসহ তার সহযোগীরা পাশবিক নির্যাতন চালাতেন। লায়লা পুলিশকে জানান, তার মতো অসংখ্য নারীকে এভাবে পাশবিক নির্যাতন চালাতো আনোয়ার বাহিনীর সদস্যরা। টাকার জন্য প্রতিদিন মানব পাচারের শিকার হওয়াদের আনোয়ার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের দৃশ্য দেখতেন লায়লা।

টেকনাফে মাওলানা রহিমের সিন্ডিকেট: এদিকে বাংলাদেশের টেকনাফে আনোয়ার সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিতেন মাওলানা আব্দুর রহিম। এই রহিমের দায়িত্ব ছিল কিছু বাংলাদেশিকে ছোট নৌকায় তুলে দেয়া। টেকনাফে রহিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিশেষ করে নরসিংদীর রায়পুরা, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, যশোরের চৌগাছা, সাতক্ষীরার কলারোয়ার দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। এসব এলাকা ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে নিরীহ মানুষদের ফুসলিয়ে নৌকায় করে আনোয়ার সিন্ডিকেটের কাছে পাঠাতেন আব্দুর রহিম।