মাজেদুল হক মানিক: কার্তিক থেকে ফাল্গুন। রবিশস্য ও শীতের সবজি আবাদের ভরা মরসুম। মেহেরপুরের কৃষকরা রবিশস্য ও সবজি আবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জেলার বিভিন্ন হাটবাজারেও চলছে অবাধে বীজ বিক্রি। তবে বীজের এ বাজার নিবন্ধনহীন ব্যবসায়ীদের দখলে। অধিকাংশ ব্যবসায়ীর বীজ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) কোনো অনুমোদন নেই। আবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে জেলার বীজের বাজার নিবন্ধনহীন ব্যবসায়ীদের কাছে উদোম হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জেলা সদর, গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলায় বরাবরই ডাল, তেল ও সবজি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এখানে উৎপাদিত ডাল, তেল ও সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। ফলে রবিশস্য ও শীতকালীন সবজি উৎপাদনের ক্ষেত্রে উন্নত বীজের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু জেলায় বিএডিসির অনুমোদিত বীজ ডিলার রয়েছে মাত্র ৬০ জন। আর সাইনবোর্ড টানানো নিবন্ধনহীন বীজ বিক্রেতা রয়েছেন দু শতাধিক। তাছাড়া স্থানীয় হাটবাজারে চট বিছিয়ে অস্থায়ীভাবে ব্যবসা করছেন আরো কয়েকশ। ফলে জেলায় বীজের বাজার নিবন্ধনহীন বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে। আর প্রতি বছর এসব বিক্রেতার কাছ থেকে বীজ ক্রয় করে চাষিদের প্রতারিত হওয়া নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, গত রবি মরসুমে জেলায় ১৭ হাজার ৪১৩ হেক্টর জমিতে গম, ৬ হাজার ৮১৫ হেক্টর জমিতে সরিষা ও ৬ হাজার ১৫৫ হেক্টর জমিতে মসুর আবাদ হয়েছিলো। চাষিরা বারি জাতের মসুর ও সরিষা লাগিয়ে ভালো ফলন পান। চলতি মরসুমে গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ রবিশস্যের আবাদ হবে বলে জানায় কৃষি বিভাগ। কিন্তু চলতি মরসুমে বিএডিসি ডিলার প্রতি ২১০ কেজি মসুর, আট টন গম ও ৪০০ কেজি সরিষার বীজ সরবরাহ করেছে, চাহিদার তুলনায় যা খুবই নগণ্য। গত মরসুমের সমপরিমাণ জমিতে এবার মসুর চাষ হলে বীজ প্রয়োজন ২৭৭ টন। কিন্তু বিএডিসি সরবরাহ করেছে মাত্র সাড়ে ১২ টন। বাদবাকিটা চাষিদের সংরক্ষিত বীজ থেকে পূরণ হবে বলে জানায় বিএডিসি। জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ও জেলা সার-বীজ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব এসএম মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিম্নমানের বীজ ব্যবহার হলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক বীজ বিক্রেতা কৃষকের কাছে নিম্নমানের বীজ বিক্রি করেন। কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। তবে বীজের বাজার দেখভালের দায়িত্ব বিএডিসির। তারপরও কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে নজরদারি রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিছু বীজ ব্যবসায়ী জানান, জেলায় মসুর ও সরিষা বীজের চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছরই তা বাড়ছে। কিন্তু বাজারে মানসম্মত বীজের অভাব রয়েছে। এ সঙ্কট কাজে লাগিয়ে জেলার অনেকে বীজ ব্যবসায়ী গ্রাম থেকে খাওয়ার উপযোগী মসুর ও সরিষা ক্রয় করে বীজ হিসেবে তা বিক্রি করেন। আবার বিএডিসির নিবন্ধনপ্রাপ্ত ডিলাররাও বিএডিসির প্যাকেটে তাদের সংগৃহীত বীজ বিক্রি করে। ডিলাররা ২১০ কেজি মসুর বীজ বরাদ্দ পেলেও বিক্রি করেছে কয়েক টন। অতিরিক্ত বীজের উৎস সম্পর্কে কোনো নজরদারি নেই। তাছাড়া তারা বিএডিসির নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে বীজ বিক্রি করছেন বলে জানান ভুক্তভোগী কৃষকরা।
সরেজমিনে মেহেরপুর ও গাংনী বাজারে দেখা যায়, বিএডিসির সরবরাহ করা মসুর বীজের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৬০ টাকায়। কিন্তু নির্ধারিত দাম ৮৮ টাকা। ওই বীজ বিক্রি বাবদ ডিলারদের ৭ শতাংশ কমিশন পাওয়ার কথা। কিন্তু তারা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন। আবার কিছু খুচরা বিক্রেতা ডিলারদের কাছ থেকে বীজ নিয়ে আরো বেশি দামে বিক্রি করছে।
গাংনী উপজেলার পূর্ব মালসাদহ গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গির আলম জানান, তিনি গত বছর খোলা বাজার থেকে মসুরের বীজ ক্রয় করে এক বিঘা জমিতে বপন করেন। কিন্তু বীজ নিম্নমানের হওয়ায় তা অঙ্কুরোদ্গম হয়নি। ফলে তার ক্ষেতে স্বাভাবিক ফলনও পাওয়া যায়নি।
গাংনীর শাহারবাটি গ্রামের মহিবুল ও তসেম উদ্দিন জানান, তারা সাহারবাটি বাজারের নিবন্ধনহীন বীজ ব্যবসায়ী আব্দুল গনির দোকান থেকে জামালপুর সিড কোম্পানির লাউয়ের বীজ ক্রয় করেন। কিন্তু ওই বীজ থেকে চারা গজায়নি। যেগুলো গজিয়েছে তার ফলন বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এতে তারা প্রতারিত হয়েছেন। একই গ্রামের আব্দুর রব ও রাজ্জাক জানান, তারা স্থানীয় দোকান থেকে করলার বীজ ক্রয় করে প্রতারিত হয়েছেন। স্থানীয় অনেক চাষি জানান, বিএডিসির বীজের মোড়ক, সিল ও ট্যাগে সহজেই নকল করা যায়। ফলে কোনটি আসল আর কোনটি নকল, সে পার্থক্য তারা ধরতে পারেন না।
গত শুক্রবার বিকেলে বামন্দী হাটে নিবন্ধনহীন বীজ ব্যবসায়ী জমির উদ্দীনের দোকানে দেখা মেলে যমুনা সিডস ও বিএডিসি মসুর বীজের প্যাকেট। রং, লেখাসহ প্যাকেটের যাবতীয় একই রকম এবং লোগো দেখতে প্রায় একই। ফলে সাধারণ চাষিদের কাছে সহজেই বিএডিসি বীজ বলে যমুনা সিডসের বীজ বিক্রি করা হচ্ছে।
বিএডিসির কুষ্টিয়া বীজ বিপণন কার্যালয়ের উপপরিচালক শাহীনুজ্জামান জানান, নকল বীজের বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। তবে স্থানীয় পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এদিকে গত রোববার মেহেরপুর জেলা বীজ প্রত্যয়ন অফিসার ডক্টর আক্তারুজ্জামান গাংনীর কয়েকটি বীজের দোকান পরিদর্শন করেন। তিনি ব্যবসায়ীদের নকল বীজ বিক্রির বিষয়ে সতর্ক করে দেন। তিনি জানান, ডাল ও মসুরবীজ দেখার দায়িত্ব কুষ্টিয়া বিপণন অফিসের। তবে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্যাকেট মোড়ক ও সিল আধুনিকায়নের কাজ চলছে, তা বাস্তবায়ন হলে কোনো কৃষক আর প্রতারিত হবেন না। বীজের মোড়কে একটি কোড নম্বর থাকবে। স্ক্র্যাচ ঘষে নির্ধারিত একটি সেলফোনে ওই কোড নম্বর পাঠালে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।