স্টাফ রিপোর্টার: সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন মুখ খুললে কে ফাঁসবেন আর কে হাসবেন তা নিয়ে বিভিন্ন মহলেই চলছে এখন সরগরম আলোচনা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিষয়ে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্যও বেরিয়ে আসতে পারে। আর যারা নূর হোসেনকে আজকের এ অবস্থায় উপনীত করেছেন তাদের চেহারাও উন্মোচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মামলার বাদীপক্ষসহ নারায়ণগঞ্জবাসীর দাবি, এ জন্য সবার আগে রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। তা না হলে অনেক সত্য আড়াল হয়ে যেতে পারে।
জানা গেছে, এক শ্রেণির নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়েই মহাজোট সরকারের বিগত আমলে নূর হোসেন হয়ে উঠেছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জের মুকুটহীন সম্রাট। শুধু সিদ্ধিরগঞ্জ নয়, পাশের জেলা মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, চর কিশোরগঞ্জ, বলাখিসহ আশপাশের লোকজনের কাছেও নূর হোসেন ছিলেন এক মূর্তমান আতঙ্ক। তাই ভারত কিংবা মেক্সিকোর আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনদের মতো হাফ ডজন গাড়ি আর এক ডজন আগ্নেয়াস্ত্রধারী বডিগার্ড নিয়ে চলাফেরাকারী নূর হোসেনের সেই প্রভাব আর ক্ষমতার পেছনের কুশীলবরা নূরকে নিয়ে এখন বেশ চিন্তিত।
আলোচনায় নেই মুন্সীগঞ্জের সেই এমপি : সাত খুনের পর নূর হোসেনের অন্যতম শেল্টারদাতা হিসেবে উঠে এসেছিল মুন্সীগঞ্জ জেলার প্রভাবশালী এমপি মৃণাল কান্তি দাসের নাম। অভিযোগ রয়েছে, ওই এমপির কারণেই দলের সভাপতির ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে নূর হোসেনের ছিল অবাধ প্রবেশাধিকার। চাঞ্চল্যকর সাত অপহরণের পর লাশ উদ্ধার হওয়ার আগের দুদিন সেখানে নিজের লোকজন নিয়ে আড্ডা দেন নূর হোসেন। ওই এমপি অবশ্য মিডিয়ার কাছে এসব অভিযোগ তখন অস্বীকার করেন। কিন্তু ২০১৪ সালে ওই এমপির নিজ নির্বাচনী এলাকা গজারিয়া উপজেলা নির্বাচনে নূর হোসেনের ক্যাডার বাহিনী তাণ্ডব চালিয়েছিল। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খুনাখুনির ঘটনাও ঘটে। মূলত অভিযোগ রয়েছে, মুন্সীগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নূর হোসেনকে মাসলম্যান হিসেবে ব্যবহার করতেন ওই এমপি।
সেই ফোনালাপ: অপরদিকে নূরের সাথে শামীম ওসমানের সেই ফোনালাপ আর জনৈক গৌর দাকে নিয়ে নতুন করে তর্কের জন্ম দিচ্ছে। গত বছরের মে মাসে নূর হোসেনের সাথে শামীম ওসমানের ওই কথোপকথনের একটি অডিও প্রকাশিত হয়। অপহরণের দুদিন পর ২৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে শামীম ওসমানকে ফোন করেন নূর হোসেন। ১০৩ সেকেন্ড কথা হয় তাদের মধ্যে। শামীম ওসমানকে ফোন করার সময় ধানমণ্ডি ৪ নম্বর সড়কের আশপাশে ছিল নূর হোসেনের অবস্থান। অভিযোগ ওঠে শামীম ওসমান কাউন্সিলর নূর হোসেনকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করেছেন। এ ঘটনায় শামীম ওসমান তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, আমার সঙ্গে ফোনে নূর হোসেন কথা বলছেন, গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা জানতেন ওই সময় নূর হোসেন ধানমণ্ডি-৪ নম্বর রোডে আছেন। কিন্তু তারা (গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা) যদি জানতেন নূর হোসেন ধানমণ্ডিতে আছেন, তাহলে তারা তাকে ধরলেন না কেন?
নূর ছিলেন উচ্ছেদ ও বিচার কমিটির সভাপতি: নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) উচ্ছেদবিষয়ক স্থায়ী কমিটি ও বিচার সালিশবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন নূর হোসেন। এমন তথ্য অনেকের কাছে অজানা থাকলেও সাত খুনের পর বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। যার বিরুদ্ধে শীতলক্ষ্যা নদী দখল, ভূমি দখল, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি আর সন্ত্রাসের পাহাড়সম অভিযোগ ছিলো তেমন একজন লোককে সিটি কর্পোরেশনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সভাপতি কি করে বানানো হয়েছিল সেই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। বিষয়টি নিয়ে তখন অনেক কাউন্সিলররাই জানিয়েছিলেন, নাসিকের স্থায়ী কমিটির শীর্ষ পদটি সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নিজ ইচ্ছায় নিরূপণ করে থাকেন। তাই এ নিয়ে সবারই ছিল মুখ বন্ধ।
যারা এখনও পর্দার আড়ালে: চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ পর নিহত নজরুল ইসলাম স্মরণে আয়োজিত একটি সভায় একটি অডিও রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। ওই অডিও রেকর্ডের সিডি তখন গণমাধ্যমকর্মীদেরও সরবরাহ করা হয়েছিল। যেখানে শোনা গিয়েছিল কাউন্সিলর নূর হোসেন, সিটি কর্পোরেশনের প্রভাবশালী ঠিকাদার আবু সুফিয়ান, ভারতে নূরের সাথে গ্রেফতার হওয়া বন্দরের কুড়িপাড়া এলাকার সেলিম ওরফে কিলার সেলিম, বন্দরের বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ী চানমিয়াসহ বেশ কয়েকজনের আওয়াজ। তারা নূর হোসেনের সঙ্গে বসে মদপান করছিলো। সেখানে একজন বলছিল, নিজে বাঁচতে হলে দুতিনটাকে মেরে ফেলতে হবে। ভিক্ষুক মারলেও ৩০২, এমপি মারলেও ৩০২, শেখ হাসিনাকে মারলেও ৩০২। প্রয়োজনে মাথা খেয়ে ফেলব। সেখানে নূর হোসেন, সুফিয়ান ও সেলিম কথোপকথনের একপর্যায়ে এমপি শামীম ওসমান ও প্রয়াত এমপি নাসিম ওসমানকেও অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করছিল। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই অডিও রেকের্ডের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তেমন কোনো অনুসন্ধান করেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া এই সেভেন মার্ডারের এক সপ্তাহ পর সেলিম ওরফে কিলার সেলিম কীভাবে বিমানযোগে ভারতে নূর হোসেনের কাছে গিয়েছিল তা নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে।