মেহেরপুর গাংনীর জোড়পুকুরিয়ায় গৃহবধূর আত্মহত্যার পর মন্তব্য জীবন দিয়ে আবেগের মাসুল দিলো কাকলী

মাজেদুল হক মানিক: প্রেমের কাছে বিয়ের বয়স ছিলো তুচ্ছ। বাধা মানেনি পরিবারের বিরোধিতা ও মতামত। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া নাবালিকা আবেগের বশেই বিয়ে করেছিলো বেকার প্রেমিককের সাথে। দাম্পত্য জীবনে সুখের রঙিন স্বপ্নে উড়ে সংসারও পেতেছিলো। কিন্তু সেই সুখ বাস্তবতার কঠিন পরীক্ষায় ভেসে যায়। শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে আবেগ আর বাস্তবতার মাসুল দিতে হলো গৃহবধূ কাকলীকে। জীবন তার কাছে এতটাই বিতৃষ্ণ হয়ে গিয়েছিলো যে দেড় বছরের শিশুপুত্রের মোহময়ী মমতাও তাকে ফেরাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত গলায় ফাঁস দিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। কাকলীর মৃত্যুর পর এমনই মতামত ব্যক্ত করেন পরিবার, স্বজন ও প্রতিবেশীরা। নিহত কাকলী মেহেরপুর গাংনী উপজেলার জোড়পুকুরিয়া গ্রামের নসিমনচালক শিমুল হোসেনের স্ত্রী। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে নিজ ঘরের আড়ার সাথে গলায় ওড়না জড়িতে আত্মহত্যা করেন। অবশ্য স্বামী-শাশুড়ির নির্যাতন সইতে না পেরে সে আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ নিহতের পিতার পরিবারের। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করেছে।

স্থানীয়সূত্রে জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল নয়টার দিকে নিজ ঘরের আড়ায় ওড়না পেচিয়ে আত্মহত্যা করেন কাকলী। এ সময় বাড়িতে কেউ ছিলো না। পরে তার শাশুড়ি এসে প্রতিবেশীদের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তার আগেই কাকলীর মৃত্যু হয়। এদিকে মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে নিহতের পিতা তেরাইল গ্রামের কাবের আলী ও মা রেখা খাতুনসহ পরিবারের লোকজন ছুটে আসেন। তারা অভিযোগ তোলেন, পারিবারিক কলহের জের ধরে স্বামী ও শাশুড়ি মিলে প্রায়ই তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতো। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে সে আত্মহত্যা করেছে অথবা নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করে গলায় ফাঁস দেয়ার নাটক সাজানো হয়েছে। থানায় তাদের লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে গতকাল সন্ধ্যার আগ মুর্হূতে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালমর্গে পাঠানোর প্রক্রিয়ায় থানায় নেয়। ময়নাতদন্তের পরই হত্যাকাণ্ড কি-না তা নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানান লাশ উদ্ধারকারী গাংনী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মেহেদি।

নিহতের পারিবারিক ও স্থানীয়সূত্রে জানা গেছে, তেরাইল গ্রামের ব্যবসায়ী কাবের আলীর মেয়ে কাকলী খাতুন স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পার্শ্ববর্তী জোড়পুকুরিয়া গ্রামের মৃত খলিলুর রহমানের ছেলে শিমুলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। বেকার ও দরিদ্র শিমুলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়নি কাকলীর পরিবার। পরিবারের অমত ও বাধা সত্বেও কাকলীর সাথে বছর চারেক আগে শিমুলের বিয়ে হয়। বছর দেড়েক আগে কাকলীর কোল জুড়ে আসে সিয়াম নামের এক পুত্রসন্তান। কিন্তু সংসার জীবনের শুরুতেই অভাব অনটনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কলহ লেগেই থাকতো। শিমুলের মা অন্যের বাড়িতে কাজ করতো। নসিমন চালানোর কাজ শুরু করে শিমুল। জোড়পুকুরিয়া মধ্যপাড়া পুরাতন বাড়ি ছেড়ে বাজারের পাশে দু কাঠা জমি কিনে বেড়ার ঘর করে। কাকলীর পিতা কাবের আলী যদিও জামাইকে গ্রহণ করতে পারেননি তারপরেও মেয়ের সুখের জন্য কিছু টাকা দেন। কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন শিমুল। শিমুলের মা সফুরা খাতুন কাকলীকে মেয়ের মতোই দেখতেন। কিন্তু সংসার করার মতো উপযুক্ত বয়স না হওয়ায় স্বামী-স্ত্রী ও শাশুড়ির মধ্যে প্রায়ই ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কলহ বেধেই থাকতো। তাছাড়া কাকলী ছিলেন জেদি ও রাগি ধরনের। এতে শাশুড়ি ও স্বামীর সাথে মাঝে মধ্যেই গণ্ডগোল সৃষ্টি হতো। এর জের ধরে প্রায়ই স্বামীর হাতে চড় থাপ্পড় জুটতো। একদিকে সংসারে অশান্তি, অন্যদিকে পিতার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ কম থাকায় আত্মহননের পথ বেছে নেয় বলে মনে করছেন তার প্রতিবেশীরা।

নিহতের স্বামী শিমুল হোসেন জানান, গত বুধবার রাতে বাড়িতে গণ্ডগোল হয়। কিন্তু সকালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মা ও স্ত্রীকে সাথে নিয়ে সকালের খাবার খেয়ে সে নসিমন নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। কিন্তু কেন তার স্ত্রী আত্মহত্যা করল তা ভেবে পাচ্ছে না শিমুল। তবে বাল্যবিয়ের কারণে তাদের সংসারে অশান্তি ছিলো এটি স্বীকার করেন তিনি। নিহতের পিতা কাবের আলী জানান, তিনি বিয়েতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু মেয়ের জেদের কাছে তার সব স্বপ্ন ধুলোর সাথে মিশে যায়। তিনি মেয়ের শ্বশুর পরিবারের থেকে দূরে থাকলেও মেয়ের ভালো থাকার জন্য সহযোগিতা করতেন। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে না পেরে সে আত্মহত্যা করেছে অথবা নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করে গলায় ফাঁস দেয়ার নাটক সাজানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন কাকলীর পিতা। গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকরাম হোসেন জানান, এ বিষয়ে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলেই বোঝা যাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন।

Leave a comment