জীবননগর ব্যুরো: নির্মাণাধীন বাড়ির সেপটিক ট্যাংকির শাটারিং খুলতে নেমে দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়া ৪ হতভাগাই নির্মাণশ্রমিক। প্রথমে দুজন নেমে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েই নীরব হয়ে যান। ছেলের নাম ধরে কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে সহকর্মীকে সাথে নিয়ে নেমে পড়লেন আর একজন। এ দুজনও আর উঠলেন না। শুরু হলো উদ্ধার তৎপরতা। জীবননগর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে দফায় দফায় ফোন করেও সাড়া মেলেনি। অগত্যা স্থানীয়রা সেপটিক ট্যাংকির পাড় ভাঙতে শুরু করেন। টেনে তুলে আনেন পিতা-পুত্রসহ ৪ জনের নিথর দেহ। হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটি ঘটে গতকাল বুধবার বিকেলে চুয়াডাঙ্গা জীবননগরের বৈদ্যনাথপুরে।
ঘটনার অনেক পরে চুয়াডাঙ্গা ফায়ার স্টেশন ও সিভিল ডিফেন্স সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছুলে স্থানীয়রা ক্ষোভ উগরে দিতে শুরু করেন। প্রশ্ন তোলেন, জীবননগর ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে বার বার ফোন করেও কেন তাদের পাওয়া গেলো না? যন্ত্রপাতি না থাকায় জীবননগর সিভিল ডিফেন্স সদস্যরা খবর পেয়েও দ্রুত ঘটনাস্থলে না পৌঁছে চুয়াডাঙ্গায় খবর দিয়ে সহযোগিতা চান বলে জানানো হয়েছে। অপরদিকে জীবননগর উপজেলা প্রশাসনের তরফে মৃত ৪ নির্মাণ শ্রমিকের পরিবার প্রতি ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক অনুদান প্রদানের তাৎক্ষণিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইউএনও নুরুল হাফিজ। একই সাথে বৈদ্যনাথপুরের ওই নির্মাণাধীন বাড়িটির নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাড়ির মালিক প্রকৌশলী রুস্তম আলীর পক্ষে অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারের প্রতি আর্থিক সহযোগিতার কোনো ঘোষণা আসেনি। শ্রমআইন অনুযায়ী- মারা যাওয়া শ্রমিকদের পরিবার প্রতি মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা। সে আইন কি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে? প্রশ্ন স্থানীয় সচেতনমহলের।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার বৈদ্যনাথপুর গ্রামের আকবর আলীর ছেলে প্রকৌশলী রুস্তম আলী দোতলা অট্টালিকা হাঁকছেন। নির্মাণাধীন এ অট্টালিকারই পায়খানার বিশাল সেপটিক ট্যাংকির ওপরের স্লাব ঢালাই দেয়া হয়েছে। ওই স্লাবে দেয়া শাটারিঙের কাঠ খোলার জন্য শ্রমিক সুজনসহ দুজন শ্রমিক বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে নিচে নামেন। নিচে নেমে তারা অক্সিজেনের অভাবে অসুস্থতার কথা বললে ওপরে অবস্থানরত অপর দু নির্মাণশ্রমিক আবুল হাশেম ও জুয়েল নিচে নামেন। এ সময় তারাও অসুস্থ হয়ে সেপটিক ট্যাংকির ভেতরে পড়ে যান। পরে এলাকাবাসী সেপটিক ট্যাংকি ভেঙে তাদেরকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে।
নিহতরা হলেন- জীবননগর উপজেলার গঙ্গাদাসপুর গ্রামের জামাত আলীর ছেলে জুয়েল (৩০), বৈদ্যনাথপুর গ্রামের নওশের আলী মণ্ডলের ছেলে জালাল উদ্দিন (৩০), ওই গ্রামের ঘরজামাই আলমডাঙ্গা উপজেলা শহরের মৃত মুনসুর আলীর ছেলে আবুল হাশেম (৪৮) ও তার ছেলে সুজন (৩০)।
জীবননগর ফায়ার স্টেশন ও সিভিল ডিফেন্স কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন জানান, সেপটিক ট্যাংকির ভেতরে অক্সিজেনের শূন্যতা সৃষ্টি হয়ে অন্যগ্যাস জমাট বাঁধে। অক্সিজেন না পেয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ৪ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ঘটনার পর একাধিকবার তাদের নিকট ফোন এসেছে। কিন্তু উদ্ধারের যন্ত্রপাতি না থাকায় তারা ঘটনাস্থলে যেতে পারেননি। ফলে তারা চুয়াডাঙ্গা ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতা নিয়েছেন বলে জানান। খবর পেয়ে জীবননগর উপজেলা চেয়ারম্যান আবু মো. আ. লতিফ অমল, উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরুল হাফিজ ও জীবননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হুমায়ন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
মৃতদেহগুলো নিজ নিজ বাড়িতে নেয়া হয়েছে। নিকটজনদের আহাজারিতে গঙ্গাদাসপুর ও বৈদ্যনাথপুরে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পিতা-পুত্রসহ ৪ নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যুর খবরে গোটা এলাকার বাতাসই যেন ভারী হয়ে উঠেছে। মন্তব্য করতে গিয়ে অনেকেই বলেছেন, একজন প্রকৌশলীর নির্মাণাধীন অট্টালিকার সেপটিক ট্যাংকিতে নেমে ৪ শ্রমিকের মৃত্যু শুধু দুঃখজনকই নয়, প্রকৌশলীর দায়িত্বশীলতাও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, সেপটিক ট্যাংকির ভেতরে বিষাক্ত গ্যাসে অক্সিজেনের অভাবে শ্রমিকদের মৃত্যুর ঝুঁকির বিষয়টি একজন প্রকৌশলীর তো জানার কথা!