দু বিদেশি হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী চিহ্নিত : রহস্য উন্মোচনের দ্বারপ্রান্তে গোয়েন্দারা

স্টাফ রিপোর্টার: অবশেষে দু বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চৌকস যৌথ টিম চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে। বলা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ হত্যা রহস্য উন্মোচনে এখন অনেকটা দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র খুনের মোটিভ ও মূল পরিকল্পনাকারীকে চিহ্নিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

সূত্রমতে, ইতোমধ্যে হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ডকে চিহ্নিত করা গেছে। কিলিং মিশনে ব্যবহৃত একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারও হয়েছে। ঘটনার সাথে জড়িত একাধিক কিলারও এখন গোয়েন্দা হেফাজতে রয়েছেন। যৌথ জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত খোলাসা করে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন খুনিরা। তাদের স্বীকারোক্তিতে যা বেরিয়ে এসেছে তার সারমর্ম হলো এ হত্যাকাণ্ড সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং দেশকে অস্থিতিশীল ও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে করা হয়েছে। আর হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হলেন সাবেক এক ছাত্রনেতা। ঘটনার পর থেকেই তিনি পলাতক রয়েছেন।

দু বিদেশি খুনের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গতকাল বৃহস্পতিবার তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের জানান, হত্যাকাণ্ডে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই এ সংক্রান্ত অগ্রগতি জানানো হবে। এদিকে মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্মকমিশনার মনিরুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ঘটনার মোটিভ সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হতে পেরেছেন। তাভেল্লার খুনিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের সাথে একেবারেই জঙ্গি সম্পৃক্ততার কোনো ভিত্তি নেই।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীকে শনাক্ত করা গেছে। তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক দলের সাবেক ছাত্র নেতা। কিলিং মিশন সফল করতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও অর্থের জোগানদাতাও তিনি। পেশাদার কিলার ভাড়া করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দুজন বিদেশি নাগরিক হত্যার মিশন সফল করতে মোটা অংকের বাজেট নিয়ে মাঠে নামেন ওই ছাত্র নেতা। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে তিনি শুরু থেকেই পর্দার আড়ালে থাকার কৌশল বেছে নেন। অবশ্য শেষরক্ষা হয়নি। রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশির খুনের তদন্ত করতে গিয়েই মূলত এ ছাত্র নেতার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। পরে তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে আটককৃত কয়েকজনের স্বীকারোক্তিতে তার সম্পৃক্ততার আদ্যোপান্ত বেরিয়ে আসে। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এখনই ওই ছাত্র নেতার নাম প্রকাশ করতে রাজি নন। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডের সাথে ওই ছাত্র নেতার জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারপরও জনমনে-জনমতে যাতে কোনো বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে সেজন্য বিষয়টি প্রকাশ করার আগে আরও যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। শতভাগ অনুসন্ধান ও যাচাই শেষ হলে তথ্য-প্রমাণসহ জড়িতদের গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা হবে। দেশে ও বিদেশে সবার কৌতূহল মেটাতে খুব শিগগির এমন একটি সংবাদ সম্মেলন দেখা যাবে।

সূত্র জানায়, ঘটনার পর থেকেই ওই ছাত্র নেতা পলাতক রয়েছেন। অথচ ঘটনার কয়েকদিন আগ পর্যন্ত তার সাথে দলীয় নেতাকর্মীদের যোগাযোগ ছিলো। কিন্তু রংপুরে সন্দেহভাজন এক কিলারকে রিমান্ডে নেয়ার পর থেকেই তিনি আড়ালে চলে যান। পুলিশ জানায়, ওই ছাত্র নেতার বিরুদ্ধে অন্তত দেড়শ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এসব মামলায় তিনি ফেরারি ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই আত্মগোপনে থেকে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছিলেন। সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়। এরপর থেকেই তিনি আত্মগোপনে আছেন। পুলিশ বলছে, আত্মগোপনে থাকা অবস্থাতেই তিনি দু বিদেশি হত্যাকাণ্ডের ছক আঁকেন। দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সাবেক এ ছাত্র নেতা বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ড ঘটান। তাকে গ্রেফতারে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, ঘটনার পর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন হিসেবে আটককৃত কয়েকজনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সন্দেহভাজন কিলারদের একজন ঘটনার সাথে নিজের জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লাকে হত্যার আদ্যোপান্ত খোলসা করেন। কীভাবে কোথা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়, মিশন শেষে অস্ত্রগুলো কোথায় রাখা হয় এরকম নানা তথ্য তিনি দিয়েছেন অনেকটা সাবলীলভাবে। কিন্তু মূল পরিকল্পনাকারীর নাম বলতে গড়িমসি করেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সন্দেহভাজন ওই কিলার মূল পরিকল্পনাকারী ও অর্থের জোগানদাতার নাম বলে দেন। এরপর তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাভেল্লা হত্যায় ব্যবহৃত দুটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি, ওই কিলারের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাভেল্লার খুনিদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও উদ্ধার করা হয়। এদিকে রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশির খুনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছে সূত্র। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জাপানি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী হিসেবেও ওই ছাত্র নেতার নাম বলেছেন। পুলিশ দাবি করছে, কুনিও হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এখন কিলিং মিশনে খুনিদের ব্যবহৃত প্রেস স্টিকারযুক্ত মোটরসাইকেলটি উদ্ধারের চেষ্টা করছে পুলিশ।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দু বিদেশি নাগরিকের হত্যাকাণ্ড মূলত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবানের অংশ হিসেবেই দু বিদেশিকে হত্যা করা হয়। ইতোমধ্যে চিহ্নিত হওয়া ওই ছাত্র নেতা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতেই বিদেশি নাগরিক খুনের সিদ্ধান্ত নেন। এ ক্ষেত্রে পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়েন তিনি। মাঠপর্যায়ে কিলারদের কাছে তার নির্দেশনা ছিলো কয়েকটা বিদেশি লাশ চাই। এ নির্দেশনা পাওয়ার পর বিদেশি লাশের মিশন বাস্তবায়ন করতে ভাড়াটে খুনিরা গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় চলে যায়। সেখানে ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লাকে হাতের নাগালে পেয়ে খুন করা হয়। এরপর খুনিরা দ্রুত গাঢাকা দেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উচ্চপদস্থ এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, দু বিদেশি খুনের পরিকল্পনাটি এককভাবে করেন ওই সাবেক ছাত্র নেতা। এ বিষয়ে তার দলীয় হাইকমাণ্ড কিছুই জানতেন না। তদন্ত করতে গিয়ে পরিষ্কার হয়েছে, বর্বরতম এ হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পেছনে ন্যূনতম সাংগঠনিক সমর্থনও ছিলো না। নিছক ব্যক্তিগত ইচ্ছা থেকেই বিদেশি খুনের ছক আঁকেন ওই ছাত্র নেতা। একপর্যায়ে নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার কিলিং মিশন সফল করতেও সক্ষম হন। তবে ঘটনার পর সবার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে খুনের দায় স্বীকারে আইএস গেম খেলেন খুনের মাস্টারমাইন্ড। এ জন্য আইএসের নামে ভুয়া টুইটবার্তাও প্রকাশ করা হয়।তাভেল্লার তিন কিলার সূত্র জানায়, ইতালির নাগরিক তাভেল্লার তিন খুনিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। অবশ্য অসমর্থিত একটি সূত্রের খবর হচ্ছে, তাভেল্লার তিন খুনিকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। গোয়েন্দা হেফাজতে রেখে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

Leave a comment