জিনের অজুহাতে সর্বরোগের চিকিৎসা দেয়ার নামে প্রতারণার দোকান
খাইরুজ্জামান সেতু/আলম আশরাফ: ‘আমেরিকার জিন চুয়াডাঙ্গা আলুকদিয়ার আকন্দবাড়িয়ার তালগাছে বসবাস শুরু করেছে। বৃহস্পতি-শনিবার বিউটির ওপর ভর করে।’ কল্পিত এ গল্পের ফাঁদ পেতে সর্বরোগের চিকিৎসার নামে প্রতারণার দোকান খোলা হয়েছে। স্থানীয় সচেতন যুবসমাজের দেয়া এ তথ্যের ভিত্তিতে গতকাল শনিবার বিকেলে ৪ জনের একদল সাংবাদিক বিউটির ডেরায় উপস্থিত হলে জিনের নামে কীভাবে এলাকার সরলসোজা মানুষের নিকট থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা, তার প্রমাণ মেলে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের আলুকদিয়া আকন্দবাড়িয়া মোল্লাপাড়ার আলাউদ্দীনের ৪ মেয়ে ১ ছেলের মধ্যে বিউটি তৃতীয়। বিউটির দু সন্তানও রয়েছে। স্বামী ডিঙ্গেদহের আনারুল। বিউটির সাথে তার স্বামীর সম্পর্কে বেশ কিছুদিন ধরেই টানাটানি চলছে। এরই মাঝে বিউটি তার পিতার সহযোগিতায় পিতার বাড়িতে পেতে বসেছেন জিনের অজুহাতে সর্বরোগের চিকিৎসালয়। বেশ কিছুদিন ধরে প্রচার-প্রচারণা চলছে। সপ্তার বৃহস্পতি ও শনিবার বিউটির ওপর জিন ভর করে বলে দাবি করে সর্বরোগের চিকিৎসা দেয়। স্থানীয় সচেতন যুবসমাজ বলেছে, বানোয়াট প্রচার-প্রচারণায় এলাকার সরলসোজা মানুষ চিকিৎসা নিতে সপ্তার শনি ও বৃহস্পতিবার ভিড় জমাচ্ছে। অবশ্য এখনও তেমন জমজমাট হয়নি বিউটির দোকান।
গতকাল শনিবার বিকেলে ৪ জন সাংবাদিকের একজন রোগী সেজে বিউটির আস্তানায় উপস্থিত হন। বিউটি খাতুন তখন জিনের আছরে মগ্নের নাটক করতে থাকেন। কয়েকজন নারী রোগীকে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। সাংবাদিক সালাম দিয়ে বসেন পাশে। বাড়ি কোথায়? প্রশ্ন করতেই বিউটি বলেন আমেরিকায়। আমেরিকার কোথায়? বিউটির জবাব আমেরিকা এলাকায়। অনেক দিন আগে এসেছি তো এখন আর ঠিকঠাক ঠিকানা বলতে পারবো না। কতো দিন আগে এসেছেন, তা বছরখানেক। এক বছরেই সব ভুলে গেছেন? প্রশ্ন তুলতেই বিউটি নীরব হয়ে যান। বলেন, জিন ফিরে গেছে তালগাছে। বাড়ির পাশেই একটি তালগাছ।
এরই মাঝে অপর তিন সাংবাদিক প্রবেশ করেন বিউটির ডেরায়। ততোক্ষণে বিউটির বাড়ির লোকজনের বোল পাল্টাতে শুরু করেছে। বলে, আমরা তো চিকিৎসা দিই না। কেউ কেউ আসে। তাই তেলপড়া, পানিপড়া দেয়া হয়। ভালো হচ্ছে শুনেই অনেকে আসছেন। এ কথার ফাঁকে জিন কি আর আসবে না? বিউটির পাশে বসে তার পিতা আলাউদ্দীন বলেন, সব সময় আসে না। ডেকে দেখা যাক আসে কি-না! আলাউদ্দীন হাত কচলতা থাকেন। ‘হু’ বলে শব্দ করতেই তার মেয়ে বিউটি খাতুন উপস্থিত সকলের উদ্দেশে সালাম দিয়ে বোঝান, তার ওপর জিন ভর করেছে। আমাদের চেনেন? বিউটির ওপর ভর করা জিন প্রথমে বলে সকলকে চিনি। সব কিছু জানি। আমরা কোথা থেকে এসেছি? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বিউটির জিনের শুরু হয় আমতা-আমতা। এক পর্যায়ে বলে চুয়াডাঙ্গায়। তারপরই জিন যেনে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
জিন কীভাবে এলো? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বিউটি বলেন, বছরখানেক আগে পেটে যন্ত্রণা শুরু হলো। কিছু খেতে পারতাম না। চুয়াডাঙ্গার অনেক ডাক্তার দেখালাম। কাজ হলো না। রাজশাহী গেলাম। ডাক্তার বললো আলসার হয়েছে। ফিরে এলাম। হাজরাহাটি বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে শুনলাম রিপনের ওপর জিন ভর করে। চিকিৎসা নিতে গেলাম। রিপনের বোতলে বন্দি করা জিনের মা এলো, আমাকে ক্ষতি করতে লাগলো। এরই মাঝে ভালো জিন এসে আমাকে উপকার করলো। চিকিৎসা দিলো। এখন আমি সব কিছু খেতে পারি। সুস্থ।
ভালো ওই জিনই তালগাছে থাকে। ওর নাম কি? বিউটি খাতুন বললেন, আমার ওপর ভর করা ভালো ওই জিনের নাম সালমা। জিনের নাম সালমা? এ প্রশ্ন শুনে বিউটি খানেকটা থতোমতো খেয়ে নীরব হয়ে গেলেন।
আমরা জানি, জিন হলো পুরুষ আর পরী হলো নারী। জিনের নাম সালমা হয় নাকি? জবাব না দিয়ে বিউটিসহ বিউটির আস্তানায় থাকা তারই সহযোগী হাজরাহাটির শরিফুল ইসলাম বললেন, আমরা অতো কিছু জানি না। অতো কিছু জানেন না তো চিকিৎসার নামে প্রতারণার দোকান খুলেছেন কেন? এ প্রশ্নের জবাব না মিললেও প্রতিবেশী এক নারী বললেন, দেখছেন না আমি ওই বিউটির জিনের কারণে কতোটা শুকিয়ে গেছি। আগে অনেক মোটা ছিলাম। প্রতিবেশী নারীর কথায় উপস্থিত অনেকেই মুখ চেপে হাসি দিয়ে বললো, যতো তাড়াতাড়ি পারো প্রতারণার এ দোকান বন্ধ করো।