স্টাফ রিপোর্টার: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড মর্যাদা দেয়ার দেড় বছরের মাথায় তা ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধাও পাননি শিক্ষকরা। গত বৃহস্পতিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে এ মর্যাদা বাতিল করা হয়। আদেশ অনুযায়ী প্রধান শিক্ষকরা নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদাপ্রাপ্ত দাবি করতে পারবেন। তবে তারা নন-গেজেটেড মর্যাদাসম্পন্ন বলেই বিবেচিত হবেন। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অনেকেই আগামী মাসে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন।
মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেয়ার পর প্রায় সারাদেশেই প্রশাসনিক পর্যায়ে কমবেশি জটিলতা তৈরি হয়েছে। উপজেলা প্রশাসনে শিক্ষা কর্মকর্তারা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। কিন্তু সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তারা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদাপ্রাপ্ত। সাধারণত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সরাসরি তদারকি করে থাকেন এটিইওরা। দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা লাভের পর প্রধান শিক্ষকদের অনেকেই এটিইওদের মানছিলেন না। বিশেষ করে স্কুল পরিদর্শনে গেলে এখতিয়ার নিয়ে অনেক প্রধান শিক্ষক প্রশ্ন তুলছিলেন। এছাড়া অনেকে নিজের বেতন নিজেরাই করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এসব জটিলতার কারণে মন্ত্রণালয় প্রধান শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে দেড় বছর পর নতুন আদেশ জারি করে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গেজেটেড মর্যাদা কেড়ে নেয়ার নেপথ্যে আরও কিছু কারণ রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে- প্রধান শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণি আর সহকারী শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষকের একধাপ নিচে বেতন-ভাতা দাবি। সম্প্রতি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছে। এরপরই শিক্ষক সংগঠনগুলো এ দাবি উত্থাপন করে।
যদিও ডিপিই মহাপরিচালক মো. আলমগীর অন্য কথা বলছেন। গতকাল শুক্রবার বিকেলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান শিক্ষকরা কখনোই গেজেটেড মর্যাদায় দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিলেন না। গত বছর প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর থেকে প্রধান শিক্ষকরা নিজেদের গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে ভাবছিলেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের নন-গেজেটেড হিসেবেই সরকার বিবেচনা করেছে। সে হিসেবে তাদের বেতন স্কেলও ৬৪০০ টাকায় নির্ধারণ করেছে। কেননা, দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তাদের স্কেল ৮ হাজার টাকা। তিনি আরও বলেন, দেড় বছরেও দ্বিতীয় শ্রেণির আর্থিক সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। অনেক শিক্ষকই পেয়েছেন। কেবল দু ধরনের ব্যক্তি এ সুবিধা পাননি। একটি হচ্ছে, যাদের কাগজপত্র ঠিক হয়নি। আরেকটি হচ্ছে যারা নিজেদের গেজেটেড হিসেবে ভেবে নিজের বেতন নিজেই করতে চেয়েছেন। এ শ্রেণির শিক্ষকরা টিইওদের করা বেতন তারা নিতে চাননি। তাই তারা পাননি। তবে মহাপরিচালকের এ দাবির সাথে একমত নন শিক্ষকরা।
প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির অফিস সম্পাদক সাতক্ষীরার মধ্য আটারই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ ফরিদউদ্দিন আহমেদ গতকাল শুক্রবার বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড মর্যাদা দিয়েছেন। আমাদের দাবিও ছিলো সেটা। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তা মহাহিসাব নিরীক্ষকের দফতর আর মাঠপর্যায়ে উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কারণে আমরা ৬৪ হাজার প্রধান শিক্ষকের কেউই আর্থিক সুবিধা পাইনি। এ শিক্ষক নেতা আরও জানান, গত বছরের ৭ আগস্ট প্রধান শিক্ষকদের সেল্ফ ড্রয়িং কর্মকর্তা ঘোষিত হওয়া প্রয়োজন মর্মে মন্ত্রণালয়কে মতামত জানায়। একই সাথে এ বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণেরও অনুরোধ জানায়। অন্যদিকে দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় উন্নীত প্রধান শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ১৭ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বাস্তবায়ন অনুবিভাগকে পত্র দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২৭ নভেম্বর এক পত্রের মাধ্যমে প্রধান শিক্ষকরা চাকরি (বেতন ও ভাতাদি) আদেশ, ২০০৯-এর ৭ (২) (৯) এর আলোকে এতদসংক্রান্ত প্রচলিত বিধি-বিধান অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদের সব আর্থিক সুবিধা প্রাপ্য হবেন মর্মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানায়। তিনি বলেন, এ অবস্থায় এখন এসে গেজেটেড মর্যাদা দেয়া হয়নি, এমন দাবি বাস্তবসম্মত নয়।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আবদুস সালাম বলেন, গত বছর ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর এক ঘোষণার মাধ্যমে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়। একই সাথে বেতন স্কেলও উন্নীত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর ওই অনুষ্ঠান থেকে আমরা মন্ত্রণালয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী চিঠিও আমাদের দেয়া হয়। কিন্তু ১৮ মাস পর এখন নানা ধরনের ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। বিষয়টি ডিপিই মহাপরিচালকও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, গত বছর জারি করা এ আদেশে বিষয়টি পরিষ্কার ছিলো না। এ কারণে নানা জটিলতারও সৃষ্টি হচ্ছিলো। এ কারণেই নতুন এ আদেশ জারি করতে হয়েছে। এতে প্রধান শিক্ষকরা যে নন-গেজেটেড মর্যাদা পেয়েছেন, সেটাই স্পষ্ট করা হয়েছে।
আর প্রধান শিক্ষকরা বলছেন, তারা গেজেটেড মর্যাদাই পেয়েছিলেন। কিন্তু এ বিষয়টি আমলারা ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছে এতোদিন। এমনকি বেতনও দেয়নি। বিষয়টি জিইয়ে রেখে দেড় বছর পর নন-গেজেটেড করা হয়েছে। এ দুরভিসন্ধি মনে ছিলো বলেই এতোদিন তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়নি বলে দাবি শিক্ষকদের। এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা পেলেও তাদের প্রত্যেকের নামে আলাদা গেজেট না হওয়ায় নতুন স্কেলে বেতন দেয়া যাচ্ছে না। এ কারণে তারা এখনও আগের মতো তৃতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় বেতন পাচ্ছেন। ডিপিই মহাপরিচালকও জানান, যাদের নামে গেজেট হয়েছে, কেবল তারাই দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদায় বেতন পাচ্ছেন।