আরাকান আর্মির সদস্য আটক : বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার

স্টাফ রিপোর্টার: বিজিবি-সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে রাঙ্গামাটির রাজস্থলী থেকে আরাকান আর্মির এক সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মিয়ানমারের নাগরিক এ যুবকের নাম অংনু ইয়ান রাখাইন। তার কাছ থেকে ৩টি ল্যাপটপ, একটি হ্যান্ডিক্যাম, ৩টি ডিজিটাল ক্যামেরা, মোবাইলফোন, ৩টি মোটরসাইকেল, ৩টি ঘোড়া ও আরাকান আর্মির ব্যবহৃত ৩ সেট পোশাক জব্দ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে অংনু জানিয়েছে, বোমার আঘাতে অনেক আগেই তার দু হাতের কব্জি উড়ে যায়। এরপর থেকে তাকে তথ্য পাচারের দায়িত্ব দিয়ে রাজস্থলীতে পাঠানো হয়েছে। তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে যৌথ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

গত বুধবার থানচির বড় মদক বিওপি ও বাতং পাড়ায় বিজিবির সঙ্গে আরাকান আর্মির গোলাগুলি হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল ঘুরে এসে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দফতর পিলখানায় সংবাদ সম্মেলনে মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, থানচির বড় মদক বিওপি ও বাতং পাড়ায় বিজিবির সাথে আরাকান আর্মির গোলাগুলির পর ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা ও ব্যবহৃত গ্রেনেডের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। বিজিবি সদস্যদের গুলিতে আরাকান আর্মির কমপক্ষে ৮-১০ জন সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ মারাও যেতে পারেন। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ১২-১২ প্লাটুন বিজিবি ও ৪-৫ প্লাটুন সেনা সদস্য ওই এলাকায় অভিযান অব্যাহত রেখেছে এবং সেখানে আরও জনবল পাঠানো হবে। মিয়ানমার সীমান্তে অরক্ষিত সীমান্ত সুরক্ষিত করার জন্য একটি এয়ার ইউনিট গঠনের প্রস্তাব করেছে বিজিবি। এ ইউনিট দুর্গম বিওপিগুলোতে লোকবল, খাদ্য পানীয় ও রেশন পাঠাবে। এ ইউনিট গঠন সম্ভব হলে সীমান্তের অরক্ষিত এলাকায় আরও ৭০টি বিওপি (সীমান্ত চৌকি) বসাবে বিজিবি।

অভিযানের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে বিজিবি ডিজি বলেন, বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় বিজিবির মদক বিওপি ও বাতং পাড়া বিওপি থেকে একটি নিয়মিত টহল দল ৪টি নৌকায় টহল দিচ্ছিল। এ সময় আরাকান আর্মির প্রায় ৫০ থেকে ৬০ সদস্য টহল দলটির ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। টহল দলটি দ্রুত নৌকা ঘুরিয়ে নিতে সক্ষম হওয়ায় এ যাত্রায় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। নৌকা থেকে নামতে গিয়ে বিজিবির নায়েক জাকির গুলিবিদ্ধ হন। আরাকান আর্মির সদস্যদের গুলিতে ঘটনাস্থলে আমাদের সদস্যরা কোনোভাবেই মাথা তুলতে পারছিলেন না। পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় থাকা দুটি হেলিকপ্টারে করে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য ও ২৪ পদাতিক ডিভিশনের কিছু সেনা সদস্য গিয়ে তাদের সাথে যোগ দেন। তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছুতে প্রায় সাড়ে ৮ ঘণ্টা সময় লেগে যায়।

এয়ার ইউনিট চায় বিজিবি: বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, মিয়ানমারের সাথে দুর্গম কিছু এলাকা সব সময় অরক্ষিত থাকে। সেখানে মাঝে মধ্যে টহল ও অভিযান হলেও বিওপি না থাকায় স্থায়ীভাবে নজরদারি করা সম্ভব হয় না। এলাকাগুলো এতোই দুর্গম যে, সেখানে এক কিলোমিটার পথ যেতেও ৬-৮ ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে অবিবেচকের মতো কিছু জওয়ান পাঠিয়ে দিয়ে বিওপি করলেই হবে না। তাদের নিয়মিত রসদ, অস্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম জোগান দিতে হবে। তাই এ এয়ার ইউনিট গঠন খুবই জরুরি। এয়ার ইউনিট থাকলে অরক্ষিত সীমান্তে আরও ৭০টি চৌকি বসানো হবে। এর মাধ্যমে পুরো সীমান্ত এলাকা বিজিবির নজরদারিতে আসবে।

ঘটনাস্থল সফর: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে সরাসরি বড় মদক যান। সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। বিকাল ৫টায় তারা সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশে ফিরে যান। জেলা সদর থেকে ঘটনাস্থল বড় মদকের দূরত্ব প্রায় ১৬০ কিলোমিটার এবং সেখানে যাতায়াত মাধ্যম পাহাড়ি পথে হাঁটা, পানিপথ ও আকাশপথ।

বিজিবির বান্দরবান সেক্টর কমান্ডার কর্নেল এসএম অলিউর রহমান জানান, বুধবার বিজিবির বড় মদক ক্যাম্পে আরাকান আর্মির সন্ত্রাসীরা ১০টি ঘোড়া আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অতর্কিতে গুলিবর্ষণ করে। বিজিবি এ ঘটনার উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। ওই এলাকায় অতিরিক্ত বিজিবি ও সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। বিমানবাহিনীর ২টি এফ-৭ বিমান বুধবার সারাদিন টহল দেয়। সীমান্তজুড়েই বিজিবি ও সেনাবাহিনীর কম্বিং অপারেশন চলছে। অপারেশন শুক্রবার সন্ধ্যা নাগাদ শেষ হবে। তবে এলাকার পরিস্থিতি শান্ত এবং সন্ত্রাসীদের ধরতে নানা কৌশলে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত একজন আরাকান নাগরিককে বেশ কিছু সরঞ্জামসহ আটক করা হয়েছে। এলাকা পরিদর্শন করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজিবির ডিজি। তারা দৃঢ়তার সাথে নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, যে কোনোভাবে হোক আরাকান আর্মি (এএ) ও আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি)-সহ সন্ত্রাসীদের উৎখাত করতেই হবে। সীমান্ত সুরক্ষার পাশাপাশি সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসী তৎপরতা দমনে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার এবং বিশেষ কম্বিং অভিযান আরও জোরদারের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বড় মদক এলাকায় মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মি (এএ) ও আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) তৎপরতা সম্পর্কে বেশ গুরুত্বপূর্র্ণ তথ্য ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে বলেও বিজিবি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

রাজস্থলীতে আটক ১: বুধবার গভীর রাতে রাজস্থলী উপজেলা সদরের সেনা ক্যাম্পের পাশে তাইতং পাড়ার কলেজপাড়ায় প্রবাসী ডা. রাইন নিন শৈয়ে মারমার বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। সেখানে একটি সুড়ঙ্গপথও পাওয়া গেছে। অবস্থানরত অংনু ইয়ান রাখাইনকে (২৫) আটক করা হয়েছে। তিনি আরাকান আর্মির সহযোগী। অভিযানে নেতৃত্ব দেন কাপ্তাই জোন কমান্ডার ও রাজস্থলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওয়াহেদুল্লাহ সরকার। রাঙ্গামাটি সেনা রিজিয়নের স্টাফ অফিসার তসলিম তারেক ও রাজস্থলী থানা পুলিশ ঘটনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তসলিম তারেক জানান, অভিযান পরিচালিত হয় বুধবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে দিবাগত রাত ২টা পর্যন্ত। এ সময় আটক এএ’র সদস্যের কাছ থেকে তার অবৈধভাবে পাচারের জন্য রাখা দুটি এরাবিয়ান ঘোড়া, পাসপোর্ট, ৩টি মোটরবাইক, ৩ সেট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম ও ৩০ গজ সেনা পোশাক, ৩টি ল্যাপটপ, ১টি হ্যান্ডিক্যাম, ৩টি ডিজিটাল ক্যামেরা, মোবাইলফোন সেট ও মডেম উদ্ধার করা হয়েছে। আটক অংনু ইয়ান রাখাইন মিয়ানমারের নাগরিক। আগের কোনো ঘটনায় বোমা স্পি­ন্টারের আঘাতে তার হাতের প্রায় অর্ধেকাংশ বিচ্ছিন্ন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অংনু ইয়ান রাখাইন জানিয়েছে, বোমার আঘাতে পঙ্গুত্ববরণ করায় তিনি আর সমরযুদ্ধে অংশ নিতে পারেন না। সে জন্য তাকে বেতন-ভাতা দিয়ে ছদ্মবেশে বসবাস করতে নির্দেশনা দেয় তার দল আরাকান আর্মি। এরপর তাকে পাসপোর্ট দিয়ে পাঠানো হয় রাজস্থলীতে। সেখানে নেদারল্যান্ডস প্রবাসী ডা. রাইন নিন শৈয়ে মারমার বাড়িতে আত্মগোপনে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। তাকে দায়িত্ব দেয়া হয় তথ্য ও এরাবিয়ান ঘোড়া পাচারের জন্য। এর আগেও ওই বাড়িতে থেকে ঘোড়া ও তথ্য পাচার করেছেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে সেনাবাহিনীকে জানান আটক অংনু ইয়ান রাখাইন।

Leave a comment