চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা-দর্শনা ও মেহেরপুরের গাংনীর বিভিন্ন গ্রামে বসতবাড়িতে জলাবদ্ধতা
স্টাফ রিপোর্টার: সাগরে লঘুচাপ ও পূর্ণিমার জোয়ার এবং টানা বর্ষণে দেশের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। ডুবে গেছে চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি। ভাঙছে নদী ও বাঁধ। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষকরা। ভোলায় জোয়ারে ভেসে যাওয়া শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ফেনীর দাগনভূঁঞায় সাপের কামড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। মাদারীপুরে হাজার হাজার মণ ধান পচে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়েছে চাতাল মালিকরা। কয়েকটি স্থানে ফেরিঘাটের গ্যাংওয়ে তলিয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় কোমেন ও মরসুমি বায়ুর প্রভাবে গতকাল শনিবারও সারাদেশে ভারী বর্ষণ অব্যাহত ছিলো। বৃষ্টিতে বাড়ছে নদ-নদীতে পানি। ভাঙা বাঁধ দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। সাভারে মাটির ঘর ভেঙে নিহত হয়েছেন এক বৃদ্ধ।
দামুড়হুদা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদায় বিরামহীন বৃষ্টির পানিতে বিধ্বস্ত হয়েছে বেশকিছু মাটির তৈরি বাড়িঘর। বাড়ির উঠোনসহ এলাকার অধিকাংশ রাস্তাই রয়েছে পানির নিচে। তলিয়ে গেছে মাঠের বিস্তীর্ণ ধানের জমিসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো মানুষ। ফলে একদিকে যেমন স্কুল পড়ুয়া কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া-আসার পথে পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তির মুখে। অপরদিকে বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না কর্মব্যস্ত সাধারণ জনগণ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দামুড়হুদা উপজেলার হাউলী ইউনিয়নের জয়রামপুর চৌধুরীপাড়ার দুটি রাস্তার ওপরে হাঁটু সমান পানি। এছাড়া ওই পাড়ার বাসিন্দা সাইদুল, আকুব্বর, মিলন, জিয়া, ছানোয়ার, সোনাজুল, হেলাল, শাবানা, পারুল, লাল্টু, দাউদ মুহুরিসহ বেশ কয়েকজনের বাড়ির উঠোনে জলাব্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। একটানা বৃষ্টির কারণে একই পাড়ার মালেক, আ. রাজ্জাক, নাজমুল ও উজ্জ্বলের মাটির তৈরি বসতঘরের দেয়াল ধসে পড়েছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে ওই এলাকার মাঠের ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত।
এ বিষয়ে হাউলী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড মেম্বার নিজাম উদ্দিন জানান, প্রায় মাসব্যাপি বিরামহীন বৃষ্টির ফলে এলাকার বেশিরভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে জয়রামপুর চৌধুরী পাড়ার জনগণ। এছাড়া গ্রামের মধ্যে জমে থাকা বৃষ্টির পানি বের করার জন্য নেই কোনো কালভার্ট বা ড্রেনেজ ব্যবস্থা। ফলে বৃষ্টির সমস্ত পানিই থেকে যাচ্ছে গ্রামের ভেতরে। অতিমাত্রায় বৃষ্টির পানিতে বেশ কয়েকজনের মাটির তৈরি বসতঘরের দেয়াল ধসে পড়তেও দেখা গেছে। খবর পেয়ে চৌধুরীপাড়ায় ছুঁটে আসেন হাউলী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী শাহ মিন্টু। তিনি পানি বন্দি মানুষের চরম দুর্ভোগের চিত্র স্বচোখে দেখেন, তাদের কথা শোনেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে ১০ জন শ্রমিক দিয়ে গ্রামের মধ্যে জমে থাকা পানি বের করার কাজ শুরু করেন।
জয়রামপুর চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা দাউদ বলেন, আমাদের বাড়িঘরে পানি ওঠে গেছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে মাঠের ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত। ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যেতে পারছে না। বাড়ির ওঠোনে পানি জমে থাকায় রান্নাও করতে পারছে না। এলাকার মানুষের চরম দুর্ভোগের কথা বিবেচনায় নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে জয়রামপুর মজা পুকুরের সামনে দামুড়হুদা-দর্শনা মহাসড়কের ওপর একটি কালভার্ট নির্মাণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী এলাকাবাসী।
দর্শনা অফিস জানিয়েছে, ২০০০ সালের আকস্মিক ভয়াবহ বন্যা আতঙ্ক এখনো কাটেনি দামুড়হুদার মানুষের মধ্যে। প্রবল বর্ষণে মাঠ-ঘাট যখন পানিতে থই থই, মাথাভাঙ্গা নদীর পানি অনেকটাই বিপদসীমার কাছাকাছি, তখনই লোকমুখে বন্যার গুঞ্জনে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গত বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতির কারণে অনেকেই গুঞ্জনে কান নিয়ে নিচ্ছে আগাম প্রস্তুতি। প্রায় দেড়মাস অবিরাম বর্ষণ হচ্ছে। এতে মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, পুকুর-নালা পানিভর্তি হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো গ্রাম-মহল্লার ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে শ শ পরিবার। টানা বর্ষণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাষাবাদ, ব্যবসা-বাণিজ্য। এরই মধ্যে বেশ কয়েক দিন ধরে গুঞ্জন উঠেছে, ২০০০ সালের মতো ভারত থেকে পানি ধেয়ে আসছে দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর-মদনা, কুড়ুলগাছি, ও কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রামগুলোতে। এ গুঞ্জনের সত্যতা না মিললে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কমেনি। সীমান্ত ঘেঁষা ইউনিয়নের গ্রামগুলোর মানুষের মধ্যে বন্যা মোকাবেলার প্রস্তুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয় ও মালামাল নিরাপদে রাখার জন্য উঁচু মাচাল নির্মাণ করতে দেখা গেছে কোনো কোনো গ্রামে। গোলা ও গোডাউনের ধানসহ কৃষিপণ্য বস্তাভর্তি শুরু করেছে অনেকেই। বন্যা মোকাবেলায় উপজেলার কার্পাসডাঙ্গায় ছোটখাট একটি আশ্রয় কেন্দ্র থাকলেও তা রয়েছে প্রভাবশালীদের দখলে। ১৯৪৫, ১৯৭১, ১৯৮৮ ও সর্বশেষ ২০০০ সালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে দামুড়হুদা উপজেলাবাসী। তবে এ পর্যন্ত কার্পাসডাঙ্গা ছাড়া কোথাও আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়নি। চুয়াডাঙ্গা জেলার মধ্যে দামুড়হুদা উপজেলা এলাকা তুলনামূলকভাবে নিচু। এছাড়া বন্যার পানি ভারত থেকে আসার কারণে প্রথমেই আক্রান্ত হতে হয় উপজেলাবাসীকে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কর্তাদের প্রতি দাবি তোলা হয়েছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যার্থদের আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্য।
গাংনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন মেহেরপুর গাংনী উপজেলার রাধাগোবিন্দপুর ধলা গ্রামের আড়াই শতাধিক পরিবার। দেড়মাস ধরে বর্ষণের ফলে মাঠঘাট ও রাস্তা ছাপিয়ে বসতবাড়ি এখন জলমগ্ন। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে গ্রাম জুড়েই। এ অবস্থায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন।
মাস দেড়েক আগে থেকে শুরু হয়েছে বৃষ্টিপাত। কখনো মাঝারি আবার কখনে ভারি বৃষ্টিপাতে ফলে গাংনী উপজেলার সীমান্তবর্তী ধলা গ্রামের নিচু এলাকার বসতবাড়িতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকা অপরদিকে ভারতীয় পানির প্রভাবে মাঠঘাট এখন টইটম্বুর। গ্রামের মধ্যে চলাচলকারী কাঁচা-পাকা রাস্তাগুলো পানির নিচে নিমজ্জিত। বাড়ির উঠোনে পানি জমায় স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারছেন না পানিবন্দি বাড়ির মানুষগুলো। গবাদিপশু ও শিশুদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করলেও সহসাই এই দুর্দশা থেকে মুক্তি মিলছে না। অব্যাহত বৃষ্টির ফলে পুকুর ও বাড়িঘর একাকার। কোনটি পুকুর আর কোনটি বাড়ির উঠান তা চেনা যায় না। পানি জমে নষ্ট হয়ে গেছে উঠানে স্থাপিত রান্নার চুলা। তাই রান্নাবান্না করতে হচ্ছে অন্যত্র। টিউবওয়েলগুলো যেন পানিতে ডোবার অপেক্ষায় দিন গুনছে। এতে সুপেয় পানি নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন ভুক্তভোগীরা। দীর্ঘদিন ধরে জলমগ্ন থাকায় এলাকার বেড়েছে পানি বাহিত রোগের প্রার্দুভাব। মশা-মাছি আর সাপের উপদ্রব যেন নিত্যসঙ্গী। পানি-কাদায় বসবাস করতে গিয়ে অনেকের হাতে-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। এমন চরম প্রতিকুলতার সাথে যুদ্ধ করে পরাস্ত হয়ে পরিবার-পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে গ্রাম ছেড়ে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন কিছু মানুষ।
ধলা গ্রামের বাসিন্দা কাথুলী ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নং ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) রুহল আমিন জানান, গ্রামের মধ্যদিয়ে যাওয়া প্রধান সড়কের দুধারে বসতি। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র। এমনিতেই ধলা গ্রাম মানে কাদা-পানির গ্রাম হিসেবে পরিচিত। প্রধান সড়কের পশ্চিম দিকের পাড়াগুলোতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এ সড়কে কোনো কালভার্ট না থাকায় পানি নিষ্কাশন হয় না। আবার পশ্চিম দিকের মাঠে ভারত থেকে আসা পানিতে থই থই অবস্থা। এই দু কারণে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন গ্রামের আড়াই শতাধিক পরিবার। তাই কালভার্টের ব্যবস্থা দ্রুত করা না গেলে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাবে ভুক্তভোগীরা।
গতকাল শনিবার বিকেলে সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের আনারুল ইসলামের বসত ঘরের সামনে কোমর সমান পানি। আব্দুর রশিদের পুকুর আর আনারুলের বাড়ি পানিতে একাকার। কোমর পানি ভেঙে ঘরে যাওয়া আস করেন বাসিন্দারা। আনারুল ইসলাম জানান, দিনের বেলায় কষ্ট করে চলাফেরা করলেও ভাঙনের ভয়ে রাতে ঘুম হয় না। তাছাড়া সাপ ও পোকামাকড়ের ভয় তো নিত্যসঙ্গী। টয়লেট করা নিয়ে চরম বিপাকে রয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন ওই পরিবারের সদস্যরা।
গ্রামের বয়োবৃদ্ধ নেকছুদ্দীন ও সোহাগী খাতুন জানান, তাদের বাড়ির আঙিনায় প্রায় কোমর সমান পানি। বর্ষার শুরুতেই পানির নিচে তলিয়ে গেছে চুলা। তাই এক প্রতিবেশীর বাড়িতে রান্না করতে হয়। কিন্তু পানিবন্দি মানুষের চাপ থাকায় রান্না করতেও সিরিয়াল দেয়া লাগে। বাড়ির আঙিনার টিউবওয়েল পানিতে ডুবুডুবু অবস্থা। এতে খাবার পানিও সংগ্রহ কষ্টসাধ্য।
শুধু চলাফেরায় সমস্যা নয় গ্রামের পানিবন্দি পরিবারগুলোর শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ রয়েছে। গ্রামের কয়েকজন জানান, অব্যহত বৃষ্টিপাতের ফলে বসতবাড়ির আঙ্গিণা ও রাস্তাঘাটে কাদায় পরিপূর্ণ। চারদিকে শুধুই পানি। তাই শিশুদের বাড়তি নজরে রাখা হচ্ছে। পানিতে ডুবে যাওয়ার ভয়ে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না। অনেকটাই গৃহবন্দি অবস্থায় বসবাস করছে পানিবন্দি পরিবারের শিশুরা।
ধলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিবুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, কয়েকটি পাড়ার শিশুরা বিদ্যালয়ে আসতে পারছে না। নিম্নচাপের প্রভাবে গতকাল সারাদিন বৃষ্টি হওয়ায় বিদ্যালয়ের উপস্থিতি ছিলো একেবারেই কম। শিশুদের এভাবে স্কুল কামাই হলে সামনের বার্ষিক পরীক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এদিকে পানিবন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য গ্রামের মানুষের উদ্যোগে গতকাল দুপুরে প্রধান সড়ক কেটে পাইপ বসানো হয়েছে। এতে সামান্য পরিমাণ পানি নিষ্কাশন হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা কিছুই না। তাই সরকারি উদ্যোগে কালভার্ট স্থাপন করে স্থায়ীভাবে পানি নিষ্কাশনের দাবি জানিয়েছেন তারা। তাছাড়া দুর্গত মানুষের জন্য সরকারি ত্রাণ সহযোগিতার দাবি করেন ভুক্তভোগীরা।
শুধু বসতবাড়িতে নয় পানির নিচে তলিয়ে গেছে ধলা বিলের বেশিরভাগ ক্ষেতের ধান। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। ব্যয় বহুল ধান আবাদে বিনিয়োগ করে এখন মাথায় হাত হাজারো কৃষকের। দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলে গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুল আমিন জানান, ঘটনাস্থল সরজমিন পরিদর্শন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।