সমাজের কিছু মানুষ যে এখনও কুসংস্কারের ঘোর অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে তা অস্বীকার করার জো নেই। সমাজে সচেতনতার আলো দিন দিন সম্প্রসারিত হলেও সর্বস্তরে পৌঁছেনি। চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের বেগমপুর ইউনিয়নের কুটালি দর্শনাপাড়ার ঘটনাটি তারই অন্যতম উদাহরণ।
ভাসুরপুত্র তাঁরা মিয়া মস্তিষ্কবিকৃত রোগে আক্রান্ত। মাঝে মাঝে তার পাগলামো বাড়ে। পাগলামি বাড়লেই অভিযোগ তুলে বলা হয়, তাঁরা মিয়ার চাচি আমেনা খাতুন মন্ত্রতন্ত্র ও গাছের বলে তাকে পাগল করছে। এ নিয়ে মতবিরোধের এক পর্যায়ে আমেনা খাতুনকে মারপিটও করা হয়েছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে গতপরশু সকালে। কুসংস্কার দূর করার নিমিত্তেই গতকাল গুরুত্বসহকারে বিষয়টি পত্রস্থ করা হয়।
পাঠকদের নিশ্চয় মনে আছে সে কথা। এইতো কয়েক বছর আগে, চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের ফার্মপাড়ার দু প্রতিবেশীর ঝগড়ার সময় এক পক্ষ হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমাদের সায়েস্তা করতে ফরিদপুর থেকে ভূত আনা হবে। ভূত দিয়ে উৎপাত ধরিয়ে উচ্ছেদ করা হবে ভিটে থেকে।’ এ হুমকির পর রাতে ঘরের চালে পড়তে লাগলো ইট, পুড়তে শুরু করলো চুলার তরকারি-ভাত। বাড়ির আশপাশে রহস্যাবৃত ছায়াও চোখে পড়লো হুমকির শিকার পরিবারের সদস্যদের। এ অভিযোগ তুলতেই মহল্লার কিছু মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়লেন। সালিসেরও আয়োজন করা হলো। সুযোগ বুঝে ওঝা কবিরাজও অর্থবাণিজ্য শুরু করে। এরই এক পর্যায়ে স্থানীয় সচেতন যুবসমাজের টনক নড়ে। তারাই দৈনিক মাথাভাঙ্গা পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে ভূতের সাথে চ্যালেঞ্জ ছোড়ে। বলে- ‘ভূত নয়, ভয়েরই ডাক নাম ভূত। কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারকে ভীতসন্ত্রস্ত্র করতে সুযোগ বুঝে ছোড়া হচ্ছে ইট। তারই কুপ্রভাবে মানসিকভাভে ভেঙে পড়ার কারণে পুড়ছে চুলার তরকারি-ভাত। ভয় দেখানো প্রতিবেশী ছদ্মবেশে অন্ধকারে ঘোরা-ফেরার কারণে ভয়ের মাত্রা বেড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি ফুটে উঠছে।’ অবাক হলেও সত্য যে, এসব উক্তি জাদুর মতো কাজে লাগে। সজাগ দৃষ্টি পড়ে বিরোধপূর্ণ প্রতিবেশী দুটি পরিবারের দিকে। ইট পড়া বন্ধ হলো। রহস্যাবৃত ছায়ায়ও আর কারো চোখে পড়লো না। ভূতের ভয়ে সন্ত্রস্ত্র পরিবারসহ মহল্লাবাসী বললো, সত্যিই মাথাভাঙ্গা ভূত তাড়ানো ম্যাজিক জানে। সেই ঘটনার পর ওই এলাকায় ভূত এনে প্রতিবেশীকে সায়েস্তা করার মতো মিথ্যা নাটকের আশ্রয় নেননি কেউ। চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের বেগমপুর ইউনিয়নের কুটালি দর্শনাপাড়ায় মন্ত্রতন্ত্র বা গাছের বুনিয়াদে কাউকে পাগল করার অভিযোগের আড়ালেও যে কুসংস্কারের অন্ধকার তা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না।
কিছু গাছ আছে যার ফল বা রস সেবনে শুধু মস্তিষ্ক বিকৃত করার জন্যই যথেষ্ট নয়, বিষক্রিয়ায় মৃত্যুও অনিবার্য হতে পারে। কিন্তু তা দূরে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে, গাছের মগডালে বেঁধে বা ঘরের চালে শুকিয়ে কাউকে কিছু করা যায় না। তাবিজকবজ, মন্ত্র-তন্ত্র? এসব সেকেলে। বান দোয়া-টানায় কিছুই হয় না। তাহলে দূরে থাকা একজনকে কীভাবে পাগল করলেন আমেনা খাতুন? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের আড়ালে হয় অসচেতনতা, না হলে নিশ্চিত ষড়যন্ত্র।
অবশ্যই সমাজ সচেতন হচ্ছে। সচেতনতা ছড়ানোর গতি কাঙ্ক্ষিত নয় বলেই বোধ করি আমেনা খাতুনকে বানোয়াট-মনগড়া অভিযোগে অভিযুক্ত করে মারপিট করা হয়েছে। অভিযোগ উত্থাপনকারীদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া দরকার। সমাজকে সচেতন করতেই বিষয়টি গুরুত্বের দাবি রাখে।