কৃষিতে স্বনির্ভরতা অর্জন এবং আমাদের ভবিষ্যত

 

কৃষিতে আমরা বহুলাংশে স্বনির্ভতা অর্জনে সংক্ষম হয়েছি। বিষয়টি স্বস্তির হলেও তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কারণ নেই। বিগত কয়েক দশকের প্রাপ্ত আলামত বলছে, বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে কৃষিতে আমাদের বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এ পূর্বাভাসকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এখনই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য।

 

বিভিন্ন গবেষণা-প্রতিবেদন ও পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যউপাত্ত হতে জানা যায়, জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ফি বছর কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে এক শতাংশ হারে। আর জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণেও আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে দ্রুত। আবাদি জমি হ্রাস অব্যাহত থাকলে আগামী ৩০ বছরের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ কৃষি জমির উত্পাদন কমে যেতে পারে। আর, উত্পাদন ক্ষমতা যদি ৩০ শতাংশ না কমে ১০ শতাংশও কমে তা হলেও বিপুল চাপ পড়বে কৃষির ওপর। এ বিষয়ে দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ না নিতে পারলে তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদী মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কেননা, আমাদের দেশে যেমন আয়ের ভারসাম্যহীনতা রয়েছে, তেমনি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়ছেই।

 

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শস্যের গুণাগুণ ও উত্পাদনের পরিমাণে পরিবর্তন আসবে। পানির স্বল্পতা ঘটবে, হ্রাস পাবে মাটির ঊর্বরতাও। চাষাবাদে নতুন নতুন বালাই দেখা দিতে পারে। ফলে কৃষিতে কীটনাশক ও সারের প্রয়োগ বৃদ্ধি পাবে। পাচ্ছে। সেচের ব্যাপকতা, ভূমিক্ষয়, বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয়, রাসায়নিকের নতুন নতুন ব্যবহার স্বভাবতই পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। সার্বিকভাবে আশঙ্কা যে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ধান ও গমের উত্পাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যেতে পারে। অথচ বাংলাদেশের মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি খাতের অবদানের প্রায় ৫৫ শতাংশ। একই সাথে দেশের প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ কৃষিকর্মে যুক্ত।

 

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম একটি নিদর্শন বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাওয়া। বিগত কয়েক বছরে আবহাওয়া হয়ে উঠেছে খামখেয়ালিপূর্ণ। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যেমন বৃষ্টি কম হয়, তেমনি আশ্বিন মাসে কয়েকদিন এমন পরিমাণে বৃষ্টি হয় যে তাতে সৃষ্টি হয় মারাত্মক জলাবদ্ধতা। খরাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও দিন দিন নিম্নমুখি হয়ে সেচকাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। আবার হঠাত বন্যার কারণে আউশ ও আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় কৃষক সেচ ও খরচনির্ভর বোরো ধানের দিকে ঝুঁকছে। তাছাড়াও পাট, গম ও আখের চাষ উত্পাদনও লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্যশস্যের দাম আগামী ২০ বছরে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। সঠিক সময়ে জমি চাষ, বীজবপন, ফসল পরিচর্যা, ফসল সংগ্রহ, বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ প্রভৃতি কাজ ব্যাহত হচ্ছে পরিবর্তিত বিরূপ জলবায়ুর কারণে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সামনে কৃষির যে ভবিষ্যিচত্র অপেক্ষা করছে-তা কপালের দুশ্চিন্তার ভাঁজ গভীরতর হচ্ছে।

 

বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধিতে কৃষির রয়েছে তাত্পর্যপূর্ণ অবদান। যেহেতু জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের এই লাগাম টেনে ধরা আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়, সেহেতু কৃষির ভবিষ্যত বিপর্যয় ঠেকাতে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় খাদ্যনিরাপত্তা কিংবা কৃষিতে আপাত সাফল্য ভবিষ্যতের গর্ভে বিলীন হবে।

Leave a comment