নাটোরের সড়কে রক্তের বন্যা : দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ৩৪

দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন

 

স্টাফ রিপোর্টার: নাটোরের বড়াইগ্রামে যাত্রীবাহী দু বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৪ যাত্রী। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অর্ধশত। গতকাল সোমবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা রাজশাহীগামী কোচ কেয়া পরিবহন ও নাটোর থেকে গুরুদাসপুরগামী লোকাল বাস অথৈ পরিবহনের মধ্যে সংঘর্ষে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। আহতদের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

দুর্ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রাত সোয়া ৭টায় ঢাকা থেকে নাটোরের পথে রওনা হন।

এদিকে দুর্ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে নাটোর ফায়ার সার্ভিস, হাইওয়ে পুলিশের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের রেজুর মোড়ে কেয়া পরিবহন (ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৫৬৫৬) একটি ট্রাককে ওভারটেক করার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা অথৈ পরিবহনের (সিলেট ব-৬৩৮৪) বাসের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ওই সময় কেয়া পরিবহনের বাসের পেছনে একটি প্রাইভেটকারের আরোহী বড়াইগ্রামের ব্যবসায়ী মাজেদুল ইসলাম নয়ন বলেন, বিকট শব্দে বাস দুটি মুখোমুখি সংঘর্ষের পর মহাসড়কের দু পাশের দুটি গর্তে ছিটকে পড়ে। দুটি বাসই দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ঘটনার সময় রাস্তায় ও আশপাশে হতাহতদের দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। দুর্ঘটনার শব্দে ও আহতদের আর্তচিৎকারে এলাকাবাসী উদ্ধার করতে ছুটে আসেন। খবর পেয়ে নাটোর, লালপুর ও দয়ারামপুর ফায়ার সার্ভিস এবং থানা ও হাইওয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে তৎপরতা শুরু করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত দু গাড়ির চালকসহ ২৯টি লাশ উদ্ধারের পর ট্রাকে করে বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। আহতদের মধ্যে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি অজ্ঞাত আরও পাঁচজন মারা যান। আহতদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতাল, বড়াইগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, বনপাড়ার বেসরকারি আমিনা হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

এদিকে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. মো. আবুল কালাম আজাদের ওপর একই দিন সকালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলার প্রতিবাদে কর্মবিরতিতে থাকা সব হাসপাতালের চিকিৎসকই প্রশাসনের অনুরোধে দুর্ঘটনার সাথে সাথে আহতদের চিকিৎসায় এগিয়ে আসেন। নাটোর জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান, পুলিশ সুপার বাসুদেব বণিক ও বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ একরামুল আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

নিহতদের মধ্যে তাৎক্ষণিক কয়েকজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন- বড়াইগ্রাম উপজেলার জোনাইল ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আওয়ামী লীগ নেতা জামাল হোসেন (৪০), তার মেয়ে জান্নাতী (৫), একই উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের আলাল উদ্দিন, সংগ্রামপুরের আবদুর রহমানের স্ত্রী আতিকা বেগম, খোকসা গ্রামের কৃষ্ণপদ সরকার (৫৫), ইন্দ পাড়া গ্রামের জান মোহাম্মদ (৪৮), গুরুদাসপুর উপজেলা প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান, তার এসও রেজাউল করিম, একই উপজেলার সিধুলী গ্রামের এবাদ আলী (৪৫), শরীফ উদ্দিন (৩০), লাবু (৩৫), আলাল (৫৫), সোহরাব হোসেন, আয়নাল হক (৩৫), সতের আলী প্রামাণিকের দুই ছেলে রব্বেল আলী (৪৫) ও আতাহার আলী (৫০), বৃচাপিলা গ্রামের বাবুল (৪০), আবদুল আওয়াল (৩০), তেলটুপি গ্রামের আবু সাইদের মেয়ে মোহনা খাতুন (৫), কহির (৩৫), তোফাজ্জল (৪৫), কিসমত (৪৫), আবদুল কুদ্দুস (৬৬), আবদুর রহমান (৫৫), রহমত (৫৫), শৈলেন তিলক (৫০), আবুল খায়ের (৬৫), আবু হানিফ (৪০), জকের আলী (৩৮) এবং অথৈ পরিবহনের চালক আলম হোসেন (৪০)।

অথৈ পরিবহনের যাত্রীদের মধ্যে বেশির ভাগই সিধুলী গ্রামের। অথৈ পরিবহনের অধিকাংশ যাত্রীই মারা গেছেন। ডা. ইয়ারুল ও আমিরুল ইসলাম জোড়া খুন মামলায় নাটোরের আদালতে হাজিরা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন বলে জানা গেছে। নাটোর জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান সন্ধ্যায় বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ২২টি লাশ উদ্ধার করে বনপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়েছে। একই সময়ে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালের ভর্তি ২০ জনের মধ্যে পাঁচজন এবং গুরুদাসপুর হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক মন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সাধারণ সম্পাদক আমিনুল হক ও জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন খান দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

২০টি লাশ হস্তান্তর: বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ওসি ফুয়াদ রুহানী বলেন, দুর্ঘটনাস্থল থেকে ২২টি এবং বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আহত অবস্থায় ভর্তিকৃতদের মধ্যে পরে নিহত চারজনসহ মোট ২৬ জনের লাশ বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা হয়। নাটোর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও পাঁচজন এবং বড়াইগ্রাম হাসপাতালে দুজন মারা যান। দুর্ঘটনায় মোট মৃতের সংখ্যা ৩৩। নাটোরের পুলিশ সুপার বাসুদেব বণিক জানিয়েছেন, নিহতের স্বজনদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে বনপাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি থেকে লাশগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। রাত ৮টা পর্যন্ত ২০টি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।

Leave a comment