পুড়ে গেলো তিন কালের সাক্ষী মেরি এন্ডারসন

 

স্টাফ রিপোর্টার: ১৯৩৩ সালে কোলকাতা শিপইয়ার্ডে জন্ম তার। ঘুরে বেড়িয়েছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা নদীর বুকে। তিন কাল অর্থাত ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তান শাসন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সাক্ষী। তার কোলে চড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ব্রিটিশ বাংলার গভর্নর। ঘুরে বেড়িয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বয়স হয়েছিলো ৮১ বছর। হঠাত আগুন লাগলো শরীরে। পুড়ে গেল মেরি এন্ডারসন। জীবনের সাড়া নেই তাতে। না, কোন মানবীর গল্প এটি নয়। এটি এককালের বিলাসবহুল প্রমোদতরী ও অধুনা ভাসমান রেস্তোরাঁ ‘মেরী এন্ডারসন’- এর গল্প। গত বুধবার রাতে নারায়ণগঞ্জের পাগলায় বুড়িগঙ্গায় আগুনে সিংহভাগ পুড়ে যায় প্রায় শতাব্দী পুরনো এ জাহাজের। ঐতিহ্যবাহী তরীটিকে পুরনো আদলে সংরক্ষণের তাগিদ দিয়েছেন ইতিহাসবিদরা।

জাতীয় আর্কাইভস সূত্র জানা যায়, ব্রিটিশ শাসন আমলে বিলাসবহুল প্রমোদতরী হিসেবে নির্মিত হয়েছিল মেরী এন্ডারসন। এটি ছিলো বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত জাহাজ। শুরুতে এর নাম ছিল ‘স্টেট ইয়ট মেরী এন্ডারসন’। ১৯৩৩ সালে কোলকাতা শিপইয়ার্ডে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ১৫০ ফুট দীর্ঘ এ জাহাজ নির্মাণে তখন ব্যয় হয়েছিলো এক লাখ ২৪ হাজার ৭০২ টাকা। বাংলায় নিযুক্ত ব্রিটিশ গভর্নরের ব্যবহারের জন্য এটি নির্মিত হয়েছিলো।

জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া থেকে জানা যায়, ১৯৩৩ সালে বাংলার গভর্নর ছিলেন স্যার জন এন্ডারসন। জন এন্ডারসনের মেয়ে মেরী এন্ডারসনের নামে এর নামকরণ করা হয় ‘স্টেট ইয়ট মেরী এন্ডারসন’। শুরুতে প্রমোদতরী হিসেবে ব্যবহূত হলেও প্রায় তিন যুগ ধরে এটি ভাসমান রেস্তোরাঁ ও বার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিলো। এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। তবে পর্যটন করপোরেশনের একটি সূত্র জানায়, ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথ ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ শাসন আমলে নৌপথে বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে তত্কালীন সরকারকে জাহাজটি তার মা রাণী মেরির নামে দান করেন। রাণীর মা মেরির নামে জাহাজের নামকরণ করা হয়।

বাংলাপিডিয়া ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান আমলেও তত্কালীন পূর্ব বাংলার গভর্নর  মেরি এন্ডারসন ব্যবহার করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের ব্যবহারের জন্য এটি সংরক্ষিত ছিলো। ঐতিহাসিক তরীটির যথার্থ ও সর্বাধিক ব্যবহারের লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান এটিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করেন। করপোরেশন তরীটিকে একটি ভাসমান রেস্তোরাঁয় রূপান্তরিত করে। ১৯৭৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর এর উদ্বোধন করা হয়। নারায়ণগঞ্জ জেলার সদর উপজেলায় বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী পাগলায় মেরী এন্ডারসনকে নোঙ্গর করে রাখা হয়। মনোরম পরিবেশে ভাসমান রেস্তোরাঁ ও বার হিসেবে এটি ব্যবহূত হয়ে আসছিলো। একটি দর্শনীয় স্থান ও চলচ্চিত্রের সুট্যিং স্পট হিসেবেও এটি পরিচিত।

দীর্ঘদিন ধরে যে স্থানে মেরী এন্ডারসন নোঙ্গর করে অবস্থান করছিলো সেই স্থানেই জাহাজের অভ্যন্তরে গত বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের ৫টি ইউনিট সোয়া এক ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে রাত ১টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। কিন্তু ততক্ষণে জাহাজটির প্রায় পুরোটাই পুড়ে গেছে। তবে কোনো হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায়নি।

Leave a comment