স্টাফ রিপোর্টার: ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে উপকূলীয় অঞ্চল। জোয়ারের পাশাপাশি প্রবল বৃষ্টিতে প্লাবিত শতাধিক গ্রামের কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় উপকূলীয় এলাকায় জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ ফুট বেশি বৃদ্ধি পায়। একের পর এক বেড়িবাঁধ ভেঙে পড়ছে। বসতভিটা, ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা তলিয়ে গেছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। সহস্রাধিক জেলে গভীর সাগরে আটকা পড়েছে। মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুট এবং দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে দু ঘণ্টা করে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকে। উপকূলবাসীদের মধ্যে বিরাজ করে ঘূর্ণিঝড়ের আতঙ্ক। সেন্ট মার্টিনে আটক পড়ে আছে তিন শতাধিক পর্যটক।
শনিবার দেশের প্রায় সব কটি বিভাগেই মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ হয়েছে। রাজধানীতেও দিনভর হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত হয়। দেশের তিন সমুদ্রবন্দরসমূহকে দেয়া তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত বহাল রয়েছে। আজ রোববার দুপুর নাগাদ ভারতের উত্তর অন্ধ্র-দক্ষিণ উড়িষ্যা উপকূল অতিক্রম করতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘হুদহুদ’ এবং ১৭০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানতে পারে অন্ধ্র প্রদেশের বিশাখাপত্তমে। আবহাওয়া অধিদফতর জানায়, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘হুদহুদ’ সামান্য পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় একই এলাকায় অবস্থান করছিলো। এটি পশ্চিম উত্তর-পশ্চিম দিকে সরে যাচ্ছে। শক্তি সঞ্চয় করে ভয়ঙ্কর হয়ে ভারতের উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় হুদহুদ। আজ রোববার আঘাত হানতে পারে বিশাখাপত্তমে।
যেভাবে শক্তি সঞ্চয় করছে, তাতে ঘূর্ণিঝড় যে ভয়ঙ্কর গতিতে আঘাত হানবে, তা এখন পরিষ্কার। সূত্রটি আরও জানায়, হুদহুদ শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১ হাজার ২০ কিলোমিটার পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৭০ কিলোমিটার পশ্চিম দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৮৮০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিলো। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। ঘূর্ণিঝড়- কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং সমুদ্রবন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে বলে জানানো হয়েছে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর কম সক্রিয় রয়েছে। আজ রোববার ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়াসহ হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা ১-৩ ডিগ্রি সে. হ্রাস পেতে পারে বলে জানায় আবহাওয়া অধিদফতর।
এদিকে, ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, হুদহুদ প্রচণ্ড সাইক্লোনিক ঝড়ে রূপ নিয়েছে। এটি এখন অনেক শক্তিশালী হয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। হুদহুদের প্রভাবে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ও প্রবল বাতাস প্রবাহিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়টি আস্তে আস্তে অন্ধ্রপ্রদেশ ও উড়িষ্যা উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ আরও জানায়, আজ রোববার বিকেল নাগাদ হুদহুদ ভারতের বিশাখাপত্তম উপকূলে আঘাত হানতে পারে। এ ব্যাপারে ভারতীয় নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। উদ্ধার ও ত্রাণ কাজ পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যে ছয়টি নৌজাহাজ প্রস্তুত করেছে দেশটির নৌবাহিনী।
আর ক’দিন পরই শুরু হবে হেমন্তকাল। এ সময় দেশে সৃষ্টি হয়েছে বর্ষার রূপ। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বিদায় নেবে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু। গত বছরও এ সময় প্রবল বৃষ্টি হয়েছিলো। সৃষ্টি হয়েছিলো নিম্নচাপ। এবার বৃষ্টি হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে। শনিবার রাজধানীসহ দেশের অনেক জেলায় হাল্কা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হয়েছে। আজ দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টি। রাজধানীতে রেকর্ড হয় ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টি। আকাশ থাকে মেঘলা।
ঘূর্ণিঝড় ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে শনিবার দুপুরে বরগুনার আমতলী উপজেলার চাওড়া ইউনিয়নের পাউবোর ৪৩/১ পোল্ডারে পশ্চিম ঘটখালী পয়েন্টে ১’শ মিটার বাঁধ ভেঙে তিন গ্রাম পাবিত হয়েছে। আমতলীসহ উপকূলীয় এলাকায় শুক্রবার রাত থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তিন গ্রামের ৭ শতাধিক কৃষক পরিবারের ৫শ’ হেক্টর আমন ফসলের ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভোলার চরফ্যাশনের মেঘনার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তলিয়ে গেছে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের প্রায় অর্ধশত গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় লাখ মানুষ। কুয়াকাটা ও তৎসংলগ্ন গভীর সাগরবক্ষে অন্তত দু’শ ট্রলার নিয়ে ইলিশ শিকারে গিয়ে উত্তাল সাগরে বিপদে পড়েছে সহস্রাধিক জেলে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে শুক্রবার থেকে সাগর ভয়াল উত্তাল হয়ে ওঠায় ট্রলার নিয়ে জেলেদের সাগরে অবস্থান করায় চরম ঝুঁকির কবলে রয়েছে। প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ট্রলার মালিকদের অতি লোভের যোগান দিতে গিয়ে এসব জেলে নিজের জীবনকে বিপন্নের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
শনিবার বৈরী আবহাওয়ার কারণে মাওয়া-কাওড়াকান্দি রুটে লঞ্চ চলাচল দু দফা বন্ধ রাখা হয়। তবে দুপুর আড়াইটা থেকে লঞ্চ সার্ভিস সচল রয়েছে। এদিকে কর্মস্থলে ফেরা মানুষের ঢল নেমেছে মাওয়ায়। এই সুযোগে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। বৈরী আবহাওয়ার কারণে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া রুটে শনিবার নৌযান চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। ফলে ঈদ ও পূজা শেষে কর্মস্থলে ফেরা মানুষ ও পরিবহন শ্রমিকরা পড়ে চরম বিপাকে। এদিকে অত্যধিক গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়ায় সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লম্বা হতে থাকে নদী পারের অপেক্ষায় আটকে থাকা যানবাহনের সারি।
সাগর উত্তাল থাকায় প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে আটকা পড়ে আছে তিন শতাধিক পর্যটক। শনিবার টেকনাফ থেকে কোনো জাহাজ সেন্টমার্টিন দ্বীপে যায়নি। দ্বীপে রাতযাপনকারী ৩ শতাধিক পর্যটক কক্সবাজারে ফিরতে পারেনি বলে জানা গেছে। তবে সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন জানিয়েছেন, পর্যটকগণ ভালো আছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে পর্যটকদের টেকনাফে পৌঁছে দেয়া হবে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীতে অস্বাভাবিক হারে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কীর্তনখোলার তীরবর্তী নগরীর নিম্নাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। শুক্রবার থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত হুদহুদের প্রভাবে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ফুট বেশি উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে। শুক্রবার রাতে আকস্মিকভাবে দক্ষিণের পায়রা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে আমতলী উপজেলার বৈঠাকাটা গ্রামের বেড়িবাঁধের প্রায় ৫০ মিটার পানিতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙা বাঁধ দিয়ে শুক্রবার রাতে ও শনিবার সকালে দু দফা পানি প্রবেশ করে বৈঠাকাটা, কালীবাড়ি ও ঘটখালী গ্রাম তলিয়ে গেছে। ওইসব এলাকার আমন ফসলসহ ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন প্রায় তিন থেকে চার ফুট পানির নিচে রয়েছে।