আলমডাঙ্গার হারানো সাংস্কৃতিক গৌরব পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা
ডা. আতিক/শরিফুল ইসলাম: মুখ থুবড়ে পড়েছে আলডাঙ্গার সংস্কৃতি অঙ্গনের কর্মকাণ্ড। হারানো সাংস্কৃতিক গৌরব পুনরুদ্ধারে প্রয়োজন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা।
জানাগেছে, এক সময় আলমডাঙ্গার দীর্ঘ সৌকর্যময় সাংস্কৃতিক ইতিহাস রয়েছে। গৌরবময় ঐতিহ্য থাকা সত্বেও বর্তমানে আলমডাঙ্গার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কতোই না আলোকিত ছিলো আলমডাঙ্গা। তা আজ শুধুই ইতিহাসের খোরাক। বৃহত্তর কুষ্টিয়ার প্রাচীণ ব্যবসা সফল মফস্বল হিসেবে সুপরিচিত ছিলো আলমডাঙ্গা। কোলকাতায় চৌরঙ্গী থিয়েটার প্রতিষ্ঠার পর উপমহাদেশে নাটকের যে সদম্ভ জয়যাত্রা শুরু হয়, বেশ অল্প সময়েই তার প্রভাব আশপাশে সংক্রমিত হয়। সে সময় ব্যবসায়িক মফস্বল হিসেবে সুপরিচিত আলমডাঙ্গায়ও তার প্রভাব পড়ে। ফলে আলমডাঙ্গার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও বেশ পুরাতন ও গৌরবজনক। ইংরেজ শাসনামলের শেষার্ধে এখানে প্রথিতযশা যাত্রাদলের পাশাপাশি বেশ নামকরা কয়েকটি নাট্যসংঘের ইতিহাস বয়স্ক মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। এ সকল অপেরা ও নাট্যসংঘগুলোর অনেকের নাম এখনও বিস্মৃত হয়নি মানুষ। এদের মধ্যে নাটক ও অপেরায় যাদের নাম আজোতক অম্লান তারা হলেন- তৎকালীন এমএলএ ইউসুফ মিয়া, হারদী হাসপাতালের জমি দানকারী আনিসুজ্জামান খান, নারায়ণ বিশ্বাস, খন্দকার খাদেমুল ইসলাম, অনীল ব্যানার্জী, খোকন অধিকারী, চিত্তরঞ্জন, সন্তোষ বিশ্বাস, মঙ্গলময় দত্ত, ডা, আজিজ, রবি অধিকারী, মনু ওকয়েকজন মাড়োয়াড়ি। এদের কেউই আর জীবিত নন। ডা মারুফুল হক, জামাল উদ্দীন কমান্ডার, হামিদুল ইসলাম আজম, ডা অমল, নূর মোহাম্মদ জকু সে গৌরবময় ঐতিহ্যের উত্তরসূরী।
৮০’র মাঝামাঝি থেকে ৯০’র দশকে নাটকের দিগন্ত আলোকিত করতেন চুন্নু, জামসিদুল হক মুনি, শামীম রেজা, আনোয়ার হোসেন, প্রশান্ত বিশ্বাস, জেহুন আলি, রাশিদুল ইসলাম, এম হাফিজ মাস্টার সেন্টু প্রমুখ। এরও অনেক আগে থেকে আলমডাঙ্গার বক্সিপুরে যাত্রার নামকরা সংগঠন ছিলো বলে শোনা যায়। ডা মারুফুল হক চালাতেন নবারুন অপেরা, স্বাধীনতার পর পর যাত্রা শুরু করে রূপসী বাংলা ক্লাব, পরে নাগরিক নাট্যদল, আরও পরে এ দলটি নাম পালটে বর্তমানে নাগরিক নাট্যাঙ্গন পরিচয়ে অস্তিত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করছে। এদের কর্মকাণ্ড বর্তমানে অশ্রুত। এ সময় সঙ্গীত চর্চারও বেশ প্রভাব ছিলো। লালন গবেষক নিয়ামত আলি মাস্টার,নীরদ কুমার বিশ্বাস, কেরু মাস্টার,স্টেশন মাস্টার শামসুল হক টুকু, বেতার শিল্পী রইচ উদ্দীনের নাম এ পর্বে বেশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। এর বেশ পর আবির্ভাব ঘটে সৃজনী ক্লাবের। রইচ উদ্দীন, নীরদ কুমার ও মোল্লা গোলাম সারোয়ার সৃজনী ক্লাবের প্রধান কর্ণধার ছিলেন। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংসদ ও কলাকেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে সংস্কৃতি চর্চায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। কলাকেন্দ্রের প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন রেবা সাহা ও ইকবাল হোসেন। মুক্তিযুদ্ধ সাংস্কৃতিক সংসদের এক সময় প্রধান চালক ছিলেন মহি উদ্দীন, তারপর খন্দকার সরোয়ার। বর্তমানে নেতৃত্বে রয়েছেন আশরাফুল হক লুলু, জামাল উদ্দীন, তুষার হক। এছাড়াও মাসুদ রানা লিটন পরিচালনা করছেন মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। মনোবেণু নামে আর একটি সংগঠনের নাম জানা যায়।
তবে এগুলোর অনেক সংগঠনই এখন হারিয়ে ফেলেছে অস্তিত্ব। বর্তমানে শুধু কলাকেন্দ্র ও মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংসদ চর্চা অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীও টিকিয়ে রেখেছে অস্তিত্ব। বাকি সংগঠনগুলো কালের আবর্তনে হারিয়ে ফেলেছে অস্তিত্ব। স্বৈরাচার হটাও আন্দোলনে আলমডাঙ্গার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের চোখে পড়ার মতোভূমিকা ছিলো। ৮০’র দশকে পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। নাটক আর সঙ্গীতানুষ্ঠানে শহরজুড়ে সাংস্কৃতিক আবহ বিরাজ করতো। কিছুটা স্বচ্ছল প্রায় পরিবারে কেউ না কেউ নাটক অথবা সঙ্গীত-আবৃত্তি চর্চার সাথে সম্পৃক্ত থাকতো। নাট্য উৎসব হতো। বেশ কয়েক দিন এক টানা চলতো এ উৎসব। শিশু-কিশোর-তরুণেরা একটি সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেতো। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতিবৃত্তায়ন, সন্ত্রাস, সর্বগ্রাসী ব্যক্তিগত স্বার্থান্ধতা সে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস করেছে। ধ্বংস করেছে মানবিক মূল্যবোধ। বর্তমানে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের অনেকেই রাজনৈতিক দলের ভাড়ামিতে ব্যস্ত, অনেকে ক্ষমতাসীনদের পদলেহন করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। বর্তমানে শুধুমাত্র কলাকেন্দ্র, মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংসদ ও মাটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ছাড়া অন্য কোনো সংগঠনের কর্মকাণ্ড দৃষ্টিগোচর হয় না। এ ৩টি সংগঠনও টিকে আছে এক রকম বৈরী পরিবেশে যুদ্ধ করে।
মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংসদের শিল্পী শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আলমডাঙ্গায় চরম বন্ধাত্ব চলছে। বছরের পর বছর ভালো কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না। রাজনৈতিকভাবে কিছু হলেও তা দায়সারা গোছের। এখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট একেবারেই নিষ্ক্রীয় হওয়ার কারণে ক্ষতিটা বেশি হচ্ছে।
আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক তাপস রশিদ মনে করেন, সম্মিলিতভাবে এ বন্ধাত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা উচিত। আলমডাঙ্গার হারানো সাংস্কৃতিক গৌরব পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে প্রশাসনও এ দায়িত্ব এড়াতে পারেনা। উচিত প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে আন্তরিকতার সাথে উদ্যোগ গ্রহণের।