ঝিনাইদহ অফিস: রক্ত রাগ, হাসনা হেনা, সাহারা, বুল বুলিস্থান, বিশ্ব নবী, বনি আদমসহ অসংখ্য কাব্য গ্রন্থের স্রষ্টা, জাগরণের কবি গোলাম মোস্তফার বসতবাড়ির জয়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে এক দখলদার। ইতোমধ্যে জমিতে সীমানা পিলার পুতে দিয়েছে দখলদারের লোকজন। যেকোনো সময় ভাঙা পড়তে পারে কবির বাসগৃহ। যেখানে রয়েছে কবির নানা স্মৃতি। রয়েছে কাচারী ঘর, যে ঘরে বসে তিনি কাব্য রচনা করতেন। কবির হাতে রোপণ করা বেশ কয়েকটি গাছ। রয়েছে কবির ব্যবহৃত জিনিসপত্র। রয়েছে চিত্রশালা ও পাঠাগার। যার সবকিছুই আজ হুমকির মুখে।
কবি গোলাম মোস্তফা ১৮৯৭ সালে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মনোহরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম গোলাম রব্বানী ও মাতা মৃত মোছা. শরিফা খাতুন। কবির ছিলো চার পুত্র ও তিন কন্যা। বর্তমানে এক পুত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা মনোয়ার। অন্য তিন পুত্র মোস্তফা আনোয়ার, মোস্তফা আজিজ ও মোস্তফা ফারুক মারা গেছেন। এর মধ্যে মোস্তফা আনোয়ার পাইলট ছিলেন। মোস্তফা আজিজ ছিলেন আটিষ্ট। আর মোস্তফা ফারুক পিয়ানো বাদন হিসেবে দেশে ও বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার প্রাপ্ত ছিলেন। কবির তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে রাশিদা হক হেনা বেঁচে আছেন। রাশিদা হক জাতীয় স্মৃতি সৌধের নকশাকার সৈয়দ মাইনুল হোসেনের মাতা। দু মেয়ে ফিরোজা খাতুন ও হাসিনা রহমান মারা গেছেন।
সরেজমিনে মনোহরপুর গ্রামে গেলে কথা হয় একাধিক ব্যক্তির সাথে। তারা জানান, কবি গোলাম মোস্তফা শুধু নয় তার সন্তানেরাও একেক জন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য ছিলেন। তাদের সকলের জন্মস্থানটি আজ দখল করে নিচ্ছে এলাকার দখলদাররা। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া মতো না। কিন্তু দখলকারীরা সন্ত্রাসী প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। আর কবির পরিবারের কেউ এখানে থাকেন না।
মনোহরপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত কবি গোলাম মোস্তফা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজ খান-নুন জানান, বতর্মানে ৫ বিঘা জমির ওপর কবি গোলাম মোস্তফার যে টিনের বাড়ি এ বাড়িটি কবির নিজের হাতে করা। তিনি বলেন, গ্রামের বয়োবৃদ্ধদের কাছ থেকে শুনেছেন কাবির মূল বাড়িটি ছিলো বর্তমান বাড়ি থেকে কিছুটা দক্ষিণে এগিয়ে। কবি গোলাম মোস্তফা ভারতের বালিগঞ্জ হাইস্কুল ও বাকুড়া জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায় ১৯৫০ সালে অবসরগ্রহণ করেন। এরপর তিনি বাড়ি ফিরে এসে পুরোনো বাড়িতে থাকতে না পেরে গ্রাম ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি মাগুরা জেলার কমলাপুরে চলে যেতে চাইলেন। তখন গ্রামের মানুষ তাকে যেতে দেয়নি। তারা রাস্তার ধারে ৫ বিঘা জমি দেন। যে জমির ওপর বাড়ি করেন কবি গোলাম মোস্তফা। কবি অবশ্য কারো কাছ থেকে জমি দান হিসেবে গ্রহণ করেননি। এ জমির পরিবর্তে মাঠে সবাইকে জমি দিয়েছেন। কিন্তু এ বদলের কিছু ছিলো লিখিত আর কিছু ছিলো মৌখিক। কবির তৈরি এ বাড়িতেই ১৯৬৪ সালে মারা যান তিনি। যারা জমি দিয়েছিলেন তারাও মারা গেছেন। তাদের একজনের সন্তান মনোহরপুর গ্রামের সদর উদ্দিন ও আলা উদ্দিন এখন দাবি করছেন কবির বাড়ির মধ্যে তাদের ২৪ শতক জমি পাওনা রয়েছে। এ জমি কবির পরিবার এতোদিন জোর করে ভোগদখল করছেন। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।
কবি গোলাম মোস্তফার ছোট মেয়ে রাশিদা হক হেনা জানান, তারা ভাই-বোনগুলো কখনও গ্রামে থাকেন না। তাদের দু চাচাতো ভাই আহম্মদ আলী ও মুকুল মুন্সী সেখানে থাকেন। তারা বাড়িটি দেখাশুনা করেন। বাড়িতে তার পিতার অনেক স্মৃতি রয়েছে। পিতার কাব্য চর্চার কাচারী ঘরটি দেখলে অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যায়। তিনি বলেন, তারা চেয়েছিলেন বাড়িটি স্মৃতি হিসেবে চিরদিন বেঁচে থাক। কিন্তু হঠাত করে বাড়ির জায়গা দখল শুরু হয়েছে। যারা এখন নিজেদের জায়গা বলে দাবি করছেন তাদের বাবা-চাচারা কখনও এ দাবি করেননি। তিনি এ দখল রোধ করার জন্য সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
এ ব্যাপারে দখলদার সদর উদ্দিনের ছেলে জিহাদ মিয়া জানান, তারা কাগজে দেখছেন জমি তাদের তাই দখলে যাচ্ছেন। এ জমির পরিবর্তে তাদের কোনো জমি বা টাকা দিয়েছিলো কি-না তা তাদের জানা নেই। জমির পরিবর্তে জমি দিয়েছেন এমন একজন মনোহরপুর গ্রামের আমিন উদ্দিন মিয়ার ছেলে নুরুল আমিন জানান, তাদের ৩৩ শতক জমির পরিবর্তে মাঠে ১৮ শতক জমি দিয়েছেন। তারা এখনও সেই জমি চাষ করছেন। যার কোনো লিখিত ছিলো না। যার এস.এ রেকর্ড তাদের নামেই আছে আর এস রেকর্ড কবির নামেই হয়েছে। এভাবে তারাও কবির জমি তাদের নামে রেকর্ড করে নিয়েছেন। যারা এখন দাবি করছেন তারাও কবির জমি নিজেদের নামে রেকর্ড করে বিক্রি করেছেন। এখন রেজিস্ট্রি না হওয়ার অজুহাতে দখল করছেন।
বিষয়টি নিয়ে শৈলকুপা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী প্রিন্সের সাথে কথা বললে তিনি জানান, খবর পেয়ে তিনি লোক পাঠিয়েছিলেন। দখলদারদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে সীমানা পিলার পুতে রেখেছেন বিষয়টি তার জানা নেই। তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান।