বদরগঞ্জ থেকে কবীর দুখু মিয়া: ১৯৭১’র স্বাধীনতাযুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলায় যারা জীবনবাজি রেখে দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা চুয়াডাঙ্গার কুতুবপুর ইউনিয়নের ভুলটিয়া গ্রামের নোয়াব আলীর ছেলে রহমত আলী। মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য ক্যাম্পে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ডাকতেন এমজি ম্যান রহমত হিসেবে। ১৯৬৮ সালে চুয়াডাঙ্গা থানা কাউন্সিল পাড়ায় মহকুমা অ্যাডজুটেন্ড মো. আলী কদর ও মো. আবদুল হান্নান আলীর অধীনে রহমত আলী বাংলাদেশ আনসার বাহিনী থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করেন। তৎকালীন সময়ে তাকে ট্রেনিং করান আনসার কমান্ডার মো. মসলেম উদ্দিন ও আবুবক্কর সালাম। ২৬ মার্চ সকালে মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী বদরগঞ্জ দশমী গ্রামের ওয়ারেশ আলীকে সাথে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা শ্রীমন্ত টাউন হলের সামনে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য অংশগ্রহণ করেন। পরদিন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ ভেড়ামারা ডাকবাংলোয় অবস্থান করেন। সেখানে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন। সেখান থেকে ঝিনাইদহের বিষয়খালী এলাকায় পাকবাহিনীর সম্মুখে অস্ত্র গোলা বারুদ নিয়ে যুদ্ধ হলে বহু আনসার কনস্টেবল ও পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত ও আহত হয়। ওই দিন রহমত আলী ঝিনাইদহের বিষয়খালী মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাঁচিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মাজদিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যোগদান করেন। সেখানে কিছু দিন ট্রেনিং করে রহমত আলী বিহার চাকুলিয়া ভারতীয় ক্যান্টনমেন্ট ১ম ব্যাচে যোগদান করে। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে একটানা ১ মাস গেরিলা ট্রেনিং শেষে ক্যাপ্টেন তৌফিক ইলাহীর নেতৃত্বে প্রায় একশ মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে বিহার চাকুলিয়া হয়ে কৃষ্ণনগর মুক্তিযোদ্ধা হেডকোয়ার্টারে অবস্থান নেন। ওই দিন রাতেই একশজনের একটি কোম্পানি ৮ নং সেক্টর শিকারপুর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গঠন করে। ক্যাম্পের (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত) মেজর এমএ মঞ্জুর রহমানের নেতৃত্বে রহমত আলী সম্মুখযুদ্ধে বিভিন্ন এলাকায় অংশগ্রহণ করেন। যোদ্ধার সময় যারা নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন তৌফিক ইলাহী, মেজর জাহাঙ্গীর আলম, ফ্লাইট লে. আবুল কালাম, কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন নুরন নবীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী সাহেবনগর, ধর্মদোয়া, মহেশকুণ্ডি, তেতুলবাড়িয়া, গোয়ালপাড়া, কাকিলাদহ, পোলতাডাঙ্গা, কুষ্টিয়া শহর প্রাগপুর সুকচা, বাজিতপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা অংশগ্রহণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ক্যাপ্টেন নুর নবীর নেতৃত্বে রহমত আলী মুক্তিযোদ্ধার পুরো কোম্পানি নিয়ে সীমান্ত পথ পার হয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসে চুয়াডাঙ্গা ক্যাম্পে। সেখান থেকে মেজর এমএ মঞ্জুর রহমানের নেতৃত্বে রহমত আলী যশোর ক্যান্টনমেন্টে যান। সকল মুক্তিযোদ্ধাকে বাছাইপূর্বক অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি দেন।
রহমত আলী বলেন, ওই দিন আমাকে আনসার বাহিনী থেকে ৭ দিনের ছুটি দিলে আমি বীরদর্পে নিজ গ্রামে চলে আসি। নিজ গ্রামে পৌঁছুলে আমার বসতভিটার রাস্তা প্রায় অচেনা হয়ে যায়। তখন আমার গ্রামের বৃদ্ধা আরশাদ মালিতাকে চাচা বলে ডাক দিলে তিনি বাড়ির সকলকে বাইরে আসার কথা বলেন। আরশাদ চাচা কাছে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কে গো? আমি রহমত আলী দেশ স্বাধীন শেষে বাড়িতে যাচ্ছি বলে পরিচয় দিলাম। তিনি চিৎকার দিয়ে গ্রামের সকলকে জানান, রহমত বেঁচে আছে। তখন গ্রামের শ শ মানুষ আমাকে ঘিরে ধরে। বাড়িতে আমার মা (ফতেমা) আমার জন্য পাগল হয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়াতেন। তবে মা জানতেন রহমত আলী মারা গেছে। যখন মায়ের কানে পৌঁছায় আমার রহমত ফিরে এসেছে, এ কথটি শোনার পর তখন মা চুলার ওপর রান্না ভাত ফেলে রেখে পাগল বেশে ছুটে আসে। তখন মায়ের মায়ের পরনে কোনো কাপড় ছিলো না। পাশে থাকা সোবারেক আলীর গায়ে থাকা চাঁদর খুলে মায়ের গায়ে জড়িয়ে দিতেই বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধা রহমতের দু চোখের অশ্রু ঝরতে দেখে প্রতিবেদকের চোখে পানি আসে। তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাজাকার থাকার কারণে পারিবারিকভাবে অনেক মানুষ নির্যাতনের শিকার হলেও দেশমাতৃকা স্বাধীন হওয়ার কারণে আজ আর তার সে দুঃখ নেই। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী আহত ভাতা না পেয়ে তাকে দেয়া হচ্ছে সম্মানি ভাতা। সময়ের চাকা ঘুরতে অবশেষে জীবন তাগিদে বীর মুক্তিযোদ্ধা রহমত আলী নিজ গ্রাম ভুলটিয়া বটতলা মুক্তিযোদ্ধা মোড়ে একটি চায়ের দোকান দিয়ে কোনো রকম সংসার চলাচ্ছেন। তবে কুতুবপুর ইউপির এলাকার সাধারণ মানুষ তাকে যথেষ্ট সম্মান করে।