মাজেদুল হক মানিক: আমাদের গাড়ি যদি অবৈধ হয় তাহলে পুলিশের দরকার হলেই তারা গাড়ি নেয় কেন? সারারাত ডিউটি করায় শুধু তেল খরচ দিয়ে। যখন তাদের দরকার হয় তখন নসিমন বৈধ। আর যখন লাগে না তখন অবৈধ? শুধু পুলিশই নয় সরকারি অফিস থেকে শুরু করে গ্রামের কৃষক পর্যন্ত কার না লাগে নসিমন? কথাগুলো বলছিলেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কয়েকজন নসিমনচালক। জেলার প্রধান সড়কে চলাচলকৃত কিছু শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধযান আলগামন গত শুক্রবার কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়ে আটক করে পুলিশ। আটকেপড়া আলগামনচালক শিমুলতলা গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, এর ওপরেই সব। গাড়ি আটকে দিলে খাব কী? তবে পুলিশ বলছে, সরকারি আদেশে শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধযান আটক করা হচ্ছে। তাই আটকের অভিযানে এর চালক ও মালিকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের দাবি যখন শুরু হয় তখন কেন বন্ধ করা হয়নি? আদালত কিংবা সরকারি আদেশের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার কমতি নেই। কিন্তু এতো টাকা খরচ করে কেনা নসিমন এখন কী হবে?
গত বৃহস্পতিবার গাংনী উপজেলা নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সরঞ্জাম ও দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ-আনসার সদস্যদের বহনকাজে ব্যবহৃত হয় অবৈধ শ্যালোইঞ্জিনচালিত যান নসিমন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসসূত্রে জানা গেছে, ৮০টি ভোট কেন্দ্রের মালামাল ও ফোর্স পৌঁছানোর জন্য শ্যালোইঞ্জিনচালিত ১৬০টি অবৈধযান ভাড়া করা হয়। মুজিবনগর উপজেলা নির্বাচনে ২৮টি কেন্দ্রের জন্য ৫৬টি এবং গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলা নির্বাচনে ৭০টি কেন্দ্রের জন্য ১৪০টি অবৈধযান ভাড়া করা হয়। এছাড়াও নতুন বছরের শুরুতে বিদ্যালয়গুলোতে নতুন বই প্রেরণসহ সরকারি জরুরি প্রয়োজনে প্রায়ই ব্যবহার হচ্ছে এসব অবৈধ যানবাহন। জেলার ১৭টি পুলিশ ক্যাম্পের মধ্যে শুধুমাত্র বামন্দী পুলিশ ক্যাম্পে একটি পিকআপ ভ্যান রয়েছে। বাকি ক্যাম্পগুলোর পুলিশ সদস্যদের রাতের টহল ও আসামি গ্রেফতারের অভিযানের একমাত্র ভরসা এসব অবৈধ যানবাহন।
গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাছুদুল আলম জানিয়েছেন, সরকারি কোনো যানবাহন নেই। এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে বাধ্য হয়ে এসব অবৈধযান ব্যবহার করা হচ্ছে। নসিমন চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলার প্রতিটি গ্রামেই এসব যানবাহন রয়েছে। এর সংখ্যা আনুমানিক পাঁচ হাজারের ওপরে। গাংনী উপজেলার সাহারবাটি, সদর উপজেলার শ্যামপুরসহ বিভিন্ন স্থানে তৈরি হচ্ছে আলগামন। দামে সাশ্রয়ী তাই সহজেই গরিব মানুষ ভাড়া খাটিয়ে উপার্জন করছেন।
স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সাথে কথা বলে এ যান সম্পর্কে পাওয়া গেছে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য। চাষি ও গরিব মানুষের প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে নসিমন, করিমন, আলগামন, ভটভটি ও আলমসাধুসহ বিভিন্ন নামীয় শ্যালোইঞ্জিনচালিত অবৈধ এসব যানবাহন। স্থানীয় হাটবাজারগুলোতে গবাদি পশু বহনের কাজে এর জুড়ি নেই। অল্প মালামাল বহনের সস্তা বাহন হিসেবেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা, কখনো ঝরছে তরতাজা প্রাণ। তাই এটিকে অনেকেই ঠাট্টা করে ‘আযরাইল পরিবহন’ হিসেবেও ডাকেন।
পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া ৫ কাঠা জমি বিক্রি করে আর সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে একটা আলগামন কিনেছিলেন গাংনীর শিমুলতলা গ্রামের আলগামনচালক রফিকুল ইসলাম। সম্প্রতি সরকার কর্তৃক (উচ্চাদলতের আদেশে) আলগামন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করায় গত দু দিন ধরে তিনি কোনো ভাড়ায় যাননি। শুধু রফিকুলই নয় তার মতো গরিব ও শিক্ষিত বেকার ছেলেরাও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে আলগামন কিংবা নসিমন কিনে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছিলেন। কিন্তু বন্ধ করে দেয়ায় তাদের মাথায় হাত। এ আদেশে তাদের সামনে শুধুই অন্ধকার। তাই আইনের আওতায় এনে স্থানীয় সড়কগুলোতে চলাচলের ব্যবস্থার দাবি তার। আবার বেশ কয়েকজন চালক জানালেন, নসিমন তৈরির কারখানা বন্ধ করে দিলে রাস্তায় আটক করতে হবে না। অবৈধ এসব যানবাহন ক্রয়ে দরিদ্র মানুষগুলো কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের প্রধান বাহন হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। তাই বন্ধ প্রক্রিয়ার মধ্যে এগুলো বিবেচনার দাবি বিভিন্ন মহলের। মেহেরপুর পুলিশ সুপার একেএম নাহিদুল ইসলাম দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে জানিয়েছেন, মহাসড়কে কোনো অবস্থাতেই এসব অবৈধ যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হবে না। কেননা এটি হাইকোর্টের নির্দেশ।