স্টাফ রিপোর্টার: বাড়লো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন। সারাদেশের ৩ লাখ ৭৫ হাজার শিক্ষকের বেতন বাড়িয়ে গতকাল রোববার আদেশ জারি করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বেতন বাড়ানোর ফলে এই শিক্ষকরা এখন জাতীয় বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে (১১ হাজার টাকার স্কেল) বেতন পাবেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম-আল হোসেন বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। এতোদিন সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা ১৪তম গ্রেডে (১০ হাজার ২০০ টাকা) এবং প্রশিক্ষণবিহীনরা ১৫তম গ্রেডে (৯ হাজার ৭০০ টাকা) বেতন পেতেন।
সচিব বলেন, বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিলো প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সম্মানজনক গ্রেডে নেয়া। সেটির বাস্তবায়ন করা হলো। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। নতুন এই বেতন স্কেল শিক্ষকদের জীবনমান আরও উন্নত করবে এবং সামগ্রিকভাবে তা শিক্ষার জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে মনে করি। তিনি জানান, শিগগিরই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বেতনও বাড়ানো হবে। তাদের বেতন সংক্রান্ত একটি মামলা আদালতে চলমান। সেটি নিষ্পত্তি হলেই তাদের বেতনও বাড়বে।
তবে বেতন বাড়ানোর এই পদক্ষেপে খুব বেশি সন্তুষ্ট হতে পারেননি শিক্ষকরা। কারণ, তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি বেতন। এ নিয়ে শিক্ষকদের মাঝে হতাশাও রয়েছে। সহকারী শিক্ষকরা চেয়েছিলেন তাদের বেতন স্কেল ১১তম গ্রেডে (১২ হাজার ৫০০ টাকা) উন্নীত করা হোক। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাবে সায় দেয়নি। বেতন স্কেল উন্নীতকরণের দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। গত নভেম্বরে তারা বেতন বাড়ানোর দাবিতে ২০১৯ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) বর্জনেরও ডাক দিয়েছিলেন। তবে সরকারের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তারা সে কর্মসূচি স্থগিত করেন। অবশেষে রোববার তাদের বেতন বাড়ানোর এই আদেশ জারি হলো। বেতন বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনরত দেশের ১৪টি প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক ঐক্য পরিষদে’র সদস্য-সচিব ও সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, আমরা এতে সন্তুষ্ট নই। খুব শিগগিরই আমরা সব সংগঠন মিলে বসে আলাপ-আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবো।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের সর্বশেষ বেতন বাড়ানো হয়েছিলো ২০১২ সালের ৯ মার্চ। তখন সহকারী শিক্ষকদের বেতন এক ধাপ বাড়িয়ে ১৫তম থেকে ১৪তম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছিলো। বর্তমানে সারাদেশে ৬৫ হাজার ৯০২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোকে ৩ লাখ ৭৫ হাজার সহকারী শিক্ষক ও ৪২ হাজার প্রধান শিক্ষক রয়েছে। প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য থাকা বাকি বিদ্যালয়গুলোতে চলতি দায়িত্ব দিয়ে চালানো হচ্ছে। এবছর বেতন বাড়লে সহকারী ও প্রধান শিক্ষক, সবমিলিয়ে প্রায় পৌনে চার লাখ শিক্ষক এ সুবিধা পাবেন।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. শামছুদ্দিন মাসুদ বলেন, পদ অনুযায়ী প্রধান শিক্ষকদের নিচের ধাপে সহকারী শিক্ষকদের অবস্থান। অথচ, এতদিন প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১১তম গ্রেডে, সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১৪তম গ্রেডে রাখা হয়েছে। এটি বৈষম্য। তাই আমাদের দাবি প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১০তম গ্রেডে নিয়ে আমাদের বেতন গ্রেড ১১তম ধাপে নির্ধারণ করা হোক।
এই নেতা বলেন, গত ৭ বছর ধরে তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য নিরসনের দাবি জানিয়ে আসছেন। অথচ তাদের দাবি পূরণ না করে প্রত্যাশার চেয়ে নিম্নতম ধাপে নির্ধারণ করা হলো। এতে সারাদেশের লাখ লাখ প্রাথমিক শিক্ষক আশাহত হবেন। তাদের প্রাণের দাবি ছিলো ১১তম গ্রেডে বেতন নির্ধারণ।
শিক্ষক নেতা শামছুদ্দিন মাসুদ বলেন, বর্তমানে একজন প্রধান শিক্ষক যে স্কেলে চাকরি শুরু করেন, একজন সহকারী শিক্ষক সেই স্কেলের এক গ্রেড নিচে চাকরি শেষ করেন, যা সহকারী শিক্ষকদের জন্য চরম বৈষম্য। তিনি বলেন, আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা যে শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে চাকরিতে যোগদান করি একই যোগ্যতায় অন্য ডিপার্টমেন্টে যারা সরকারি চাকরি করেন তাদের বেতন গ্রেডও আমাদের তুলনায় ৩ থেকে ৪ ধাপ উপরে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষকদের চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে অন্য ডিপার্টমেন্টে সহকারী শিক্ষকদের তুলনায় বেশি বেতনে চাকরি করেন। আমরা সম্মানজনক বেতন স্কেল প্রত্যাশা করি, যা আমাদের সামাজিক মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক উভয়েই ১৩৫ টাকা বেতন পেতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণের পরবর্তীতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মাঝে বেতনের কোনো ব্যবধান ছিলো না। প্রধান শিক্ষকরা কার্যভার ভাতা হিসেবে ১০ টাকা বেশি পেতেন। ১৯৭৭ সালে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বেতন পেতেন ১৫তম গ্রেডে ৩২৫ টাকা তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক পেতেন ১৬তম গ্রেডে ৩০০ টাকা। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে গ্রেডের ব্যবধান ছিলো ১ ধাপ।
১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বেতন পেতেন ১৬তম গ্রেডে ৭৫০ টাকা এবং একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক বেতন পেতেন ১৭তম গ্রেডে ৬৫০ টাকা। ব্যবধান ছিলো ১০০ টাকা। ২০০৬ সাল পর্যন্ত একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ১৬তম গ্রেডে ৩,১০০ টাকা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক ১৭তম গ্রেডে ৩,০০০ টাকা বেতন পেতেন। ব্যবধান ১০০ টাকাই ছিলো। কিন্তু ২০০৬ সালের ২৯ আগস্ট বেতন আপগ্রেডের নামে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের ১৩তম গ্রেডে ৩,৫০০ টাকা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের ১৫তম গ্রেডে ৩,১০০ টাকা বেতন নির্ধারণ করা হয়। এই সময় ২ ধাপ বেতন বৈষম্যের সৃষ্টি হয় এবং বেতনের ব্যবধান হয় ৪০০ টাকা।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ও পদমর্যাদা বৃদ্ধির ঘোষণা দেন। তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হয় ২য় শ্রেণির পদমর্যাদাসহ ১১তম গ্রেডে ৬,৪০০ টাকা এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকের বেতন স্কেল নির্ধারণ করা ৩য় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে ১৪তম গ্রেডে ৫,২০০ টাকা। বেতন গ্রেডের পার্থক্য হয় তিন ধাপ। ৩য় শ্রেণি থেকে প্রধান শিক্ষকগণ ২য় শ্রেণিতে উন্নীত হলেও সহকারী শিক্ষকরা ৩য় শ্রেণির পদেই থেকে যান। বেতন আপগ্রেডের সময় মূল বেতনের ব্যবধান হয় ১২০০ টাকা এবং ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় প্লে-স্কেলে সে ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ২৩০০ টাকা। জাতির জনকের সময়ে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের মধ্যে বেতন স্কেলের ব্যবধান না থাকলেও এতোদিন তিন ধাপ ব্যবধানে ছিলো।
নতুন বেতন স্কেল নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে রংপুর ক্যাডেট কলেজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রওশন আরা বীথি বলেন, নতুন বেতন স্কেলে বেতন ফিপেজেশন নিয়ে নতুন সমস্যা তৈরি হবে। চাকরি পরবর্তী প্রশিক্ষণ গ্রেড নিম্মধাপে সংযুক্ত করায় এবং নতুন গ্রেডে সমতা না আনা হলে হাজার হাজার শিক্ষক আর্থিক ক্ষতির শিকার হবেন। যা তাদের পেনশনে নতুন শিক্ষকদের চেয়ে অন্তত সাত থেকে আট লাখ টাকার পার্থক্য তৈরি করবে।
সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার মৈশাষী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা চেয়েছিলাম জাতীয় বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেড। অথচ মন্ত্রণালয় থেকে দেয়া হলো ১৩তম গ্রেড। এতে শিক্ষক সমাজ অসন্তুষ্ট ও মনোক্ষুণœ। শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ালে তা হবে জাতি গড়ার জন্য বিনিয়োগ। তিনি বলেন, সদাশয় সরকার নিশ্চয়ই শিক্ষকদের মনের আকুতি বুঝবে।