রহমান মুকুল: আলমডাঙ্গার ফরিদপুর গোলবাগানে বৃহত্তর কুষ্টিয়াঞ্চলে মরমি সুফিবাদের প্রবর্তক রায়হান উদ্দীন গাজীর ২ দিনব্যাপী স্মরণোৎসব শুরু হয়েছে। গতকাল ৩০ জানুয়ারি বিকেলে এ মহান মরমি সাধকের স্মরণোৎসবের শুভ উদ্বোধন করা হয়েছে।
গোলবাগানের সভাপতি সাধু ঠা-ু বিশ্বাসের সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বেলগাছি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক চঞ্চল, রোকন হাসান টিপু, লাল্টু হোসেন, উর্মিলা সরকার, রেজাউল করিম জোয়ার্দ্দার, লাবলু, তরিকুল ইসলাম, আল্পনা সরকার, বাউল আকবার আলী শাহসহ কয়েকশ সাধু বাউল ভক্তবৃন্দ।
প্রসঙ্গত. রায়হান উদ্দীন গাজী। কালের আবর্তে আজ এই মহান মরমি সাধকের নাম সকলেই বিস্মৃত প্রায়। এতদাঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারে ক্ষেত্রে তার অবদান সর্বাধিক বিবেচনা করা হয়। প্রতীয়মান হয়-এতদাঞ্চলে তিনিই প্রথম মরমী সুফিবাদের প্রবর্তক। তবে রণগাজী বিশ্বাস নামেই তিনি আজ সমধিক পরিচিত। তার আসল নাম ঢাকা পড়ে গেছে বিস্মৃতির আড়ালে। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার ফরিদপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে অবস্থান করে তিনি মরমি সুফিবাদ প্রচার করতেন। এখনও কালের স্মারক হয়ে টিকে আছে তার মরমি সুফীবাদ প্রচারস্থল, গোলবাগান। তিনি ছিলেন খান জাহান আলীর শিষ্য ও সহযোদ্ধা।
খান জাহান আলী (রহ.) ১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে তুঘলক সেনাবাহিনীতে সেনা পদে কর্ম জীবন শুরু করেন। অল্প সময়ে তিনি প্রধান সেনাপতির পদে উন্নীত হন। সে সময় শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ’র বংশধর নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ দিল্লির মসনদে অধিষ্ঠিত। খান জাহান আলী শুধু সেনাপতিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন নাসির উদ্দীন মাহমুদ শাহ’র বিশ্বস্ত বন্ধু। ১৪০০ থেকে ১৪১১ সালের মধ্যে যেকোনো বছর তিনি বাংলা আক্রমণ করলে দিনাজপুরের রাজা গনেশ ভাতুরিয়াতে পালিয়ে যায়। দিনাজপুরের রাজাকে পরাজিত করার পর রাজকোষের প্রচুর ধন সম্পদ খান জাহান আলী তার সহচর যোদ্ধাদের মাঝে ভাগ করে দেন। বাংলা বিজয়ের পর হজরত খান জাহান আলী (রহ.) দক্ষিণ বাংলার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এরই এক পর্যায়ে ১৪১৮ সালে ঝিনাইদহ’র বারো বাজারে অবস্থান নেন। খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এ বারো বাজার গঙ্গারিডির রাজধানী ছিলো বলে জানা যায়। খান জাহান যখন বার বাজারে অবস্থান করেন সে সময় বার বাজারের নাম ছিলো ছাপাই নগর বা চাম্পাই নগর। খান জাহান আলী (রহ.) সেখানে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। খান জাহান আলীর আগমনে এই প্রাচীন নগরীতে নতুন প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বারো বাজার থেকে খান জাহান আলী মুরলিতে উপস্থিত হন। যশোর শহরের পূর্ব নাম ছিলো মুরলি কসবাই। মুরলি থেকে হযরত খান জাহান আলীর অনুচররা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। প্রথম দল মুরলি থেকে খানপুর হয়ে বিদ্যানন্দ কাঠিতে অবস্থান নেন। এখানে বিরাট দীঘি খনন করা হয়েছিলো। এ দলের নেতৃত্ব দেন বোরহান খাঁ বা বুড়ো খাঁ। অন্যদল ভৈরব নদীর তীর ধরে পয়গ্রাম কসবত হয়ে বাগেরহাট পৌঁছান। হযরত খান জাহান আলী (র.) স্বয়ং এ দলের নেতৃত্ব দেন।
যুদ্ধ শেষে দিনাজপুর থেকে দক্ষিণ বাংলায় যাওয়ার পথে অর্থাৎ বার বাজারে উপস্থিত হওয়ার আগেও খাঁন জাহান আলী তার সবচে’ অনুগত সহচর ও নীতিবান সৈনিকদের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে রেখে যান। মেহেরপুরের পীর মেহেরুল্লাহ, শেখ ফরিদ, চারুলিয়ার চার পীর, আলমডাঙ্গার ফরিদপুর গ্রামের রায়হান উদ্দীন গাজী প্রমুখকে মানবতার ধর্ম প্রচারের দায়িত্ব দেন তিনি। সঙ্গে অঢেল অর্থও। উল্লেখ্য যে, খান জাহান আলীর সবচে’ বিশ্বস্ত ও সুযোগ্য ৩৬০ জন শিষ্যের জন্য তিনি তাদের নামে ৩৬০টি পুকুর খনন ও ৩৬০টি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পীর মেহেররুল্লাহ, শেখ ফরিদ, চারুলিয়ার ৪ পীর কিংবা রায়হান উদ্দীন গাজী এই ৩৬০ জনের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না বোধ হয়। ধারণা করা হয়, ১৪১৮ সালেই তরুণ ধর্ম প্রচারক রায়হান উদ্দীন গাজী ফরিদপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তখন আলমডাঙ্গা জনপদের অস্তিত্ব ছিলো না। দূরে শুধুমাত্র বেলগাছি গ্রামের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিলো। ছোটখাট জনপদ ফরিদপুরেই তিনি শুরু করেন ইসলাম প্রচার। ইসলামের কঠোর শরিয়তপন্থী খান জাহান আলীর সুযোগ্য শিষ্য রায়হান উদ্দীন গাজী ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে ইসলাম ধর্মের আলো জ্বালাতে নিরলস পরিশ্রম করছিলেন। অথচ কঠোর পরিশ্রমেও মানুষের মাঝে সাড়া জাগাতে পারছিলেন না। এই অঞ্চলের মানুষ গান-বাজনা নিয়েই মেতে থাকতে পছন্দ করতেন। নামে মুসলমান হলেও ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে তাদের সাক্ষাৎ ছিলো না। বরং বাউল মতবাদে উৎসাহী ছিলেন। তিনি অনুধাবন করছিলেন এ অঞ্চলের প্রকৃতিও আবহাওয়া মানুষকে ঘর ছাড়া উদাস বাউন্ডেলে জীবনযাপন করতে প্রলুব্ধ করে। এ সকল আত্মভোলা মানুষকে তিনি, শরিয়তের সুকঠিন অনুশাসনের নিগড়ে শ চেষ্টায়ও বাঁধতে পারেননি। কিন্তু হাল ছাড়েননি। থেমে যাওয়ার জন্য তো আসেননি। যে মহান ব্রত নিয়ে তিনি এখানে এসেছিলেন, তা সফল করবেনই এমন পণ। সাথে তাঁর খান জাহান আলীর আশীর্বাদ রয়েছে। তিনি ইসলাম প্রচারের সুমহান স্বপ্ন বুকের গভীরে লালন করে সাধারণ মানুষের সাথে আরও বেশি একাত্ম হতে থাকলেন। যুদ্ধবিজয়ী গাজী সৈনিক হিসেবে বিপুল বিত্ত-বৈভব ছিলো তার। মানুষের বিপদ-আপদে অকাতরে অর্থ বিলোতেন। বুঝতে পারেন শরিয়তের কঠোর বাঁধনে এদের বাঁধা যাবে না। ফলে সরে আসেন শরিয়তের কঠিন অনুশাসন থেকে। কৌশল পরিবর্তন করেন ধর্ম প্রচারের। গান বাজনার আয়োজন করে তিনি গ্রামবাসীকে সেখানে আমন্ত্রণ জানাতেন। সকল এলাকাবাসীকে এনে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা দিতেন। অল্প কয়েক বছরেই তিনি বেশ সফল হলেন। তার নিকট থেকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা নিতে বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন। জীবদ্দশায় তিনি ধর্মীয় চেতনায় আলোকিত করেন গোটা এলাকা। হয়ে ওঠেন জীবন্ত কিংবদন্তী। মধ্য যৌবনে তিনি ধর্ম প্রচারস্থলে গড়ে তোলেন মনোরম বাগান। যা বর্তমানে গোলবাগান নামে সমধিক খ্যাত। এখানে তিনি নিজ হাতে রোপণ করেছিলেন তাল, তেতুল, বকুল, কুল গাছসহ নানাবিধ বৃক্ষ। তার নিজ হাতে রোপণকৃত কিছু তালগাছ ও তেতুল গাছ কালের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে প্রায় ৫শ বছরের অধিক যাবত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গোড়ামী আর অধর্মের নিকষ অন্ধকার থেকে মানুষকে মানবাতার আলোয় আলোকিত করেন। বাতলে দেন সঠিক পাথেয়। এলাকায় প্রচলিত লৌকিক কাহিনি মতে- প্রায় ১৫০০ সালের দিকে তিনি ভক্ত পরিবেষ্ঠিত অবস্থায় অন্তর্ধান করেন। অন্তর্ধানসহ তার সম্পর্কে বহু মিথ এলাকায় প্রচলিত। ধারণা করা হয়, এই বৃহত্তর কুষ্টিয়াঞ্চলে তিনিই প্রথম মরমি সুফিবাদের বা ভাববাদের প্রবর্তক। তার মৃত্যুর শ শ বছর পরও এই ফরিদপুর গ্রাম মরমি সাধকের পীঠস্থান হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। এখানে মানবতা- ধর্মের যে আলোশিখা তিনি জ্বালিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তা বৃহত্তর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। লালন শাহসহ বহু মরমি সাধক তার মৃত্যুর শ শ বছর পরও ফরিদপুর গোলবাড়ি আসতেন বলে কথিত আছে। পরবর্তীতে বেহাল শাহ, শুকলাল শাহসহ অনেক মরমি সাধকেরা ফরিদপুর গ্রামকে তীর্থস্থান ভেবে এখানেই সাধন-ভজন করে জীবন কাটিয়েছেন। রায়হান উদ্দীন গাজীর অন্তর্ধানের পর তার মরমি সুফি মতবাদের সুযোগ্য ধারক-বাহক বা শিষ্য ছিলো না। ফলে কালক্রমে তা আবারও সর্বগ্রাসী বাউল মতবাদ গ্রাস করে। লালন শাহ পরবর্তী সময়ে এ গ্রামকে ৭শ ফকিরের গ্রাম বলা হতো। আজও তার একটা ক্ষীণ ধারা বহমান।
এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম প্রায় কিছুই জানে না। এ মহান ধর্ম প্রচারকের প্রকৃত নামটাই ভুলে গেছে। অথচ লালন পূর্বসূরি এই মহান মরমি সুফিবাদের প্রবর্তক সম্পর্কে কেহ তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। এটা যতোটা দুঃখজনক, ততধিক আত্মঘাতীও। এমন মন্তব্য বিদগ্ধ সমাজের।