প্রস্তাবের বিপরীতে বিইআরসি মূল্যায়ন কমিটি ১৯ দশমিক ৫০ ভাগ বাড়াতে বলেছে
স্টাফ রিপোর্টার: বিদ্যুতের পাইকারি দামের পাশাপাশি সঞ্চালন মাশুলও বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মূল্যায়ন কমিটি। গতকাল সকালে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড ও বিকেলে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) প্রস্তাবের ওপর শুনানিতে এ সুপারিশ করা হয়। এর ফলে বিদ্যুতের খুচরা দাম ফের বাড়তে যাচ্ছে। দাম বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে শিল্প, বাণিজ্য ও আবাসিকসহ সব শ্রেণির গ্রাহকের মধ্যে। শুনানিতে পিডিবির ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ দর বৃদ্ধির প্রস্তাবের বিপরীতে কমিশনের মূল্যায়ন কমিটি ১৯ দশমিক ৫০ শতাংশ দর বৃদ্ধির সুপারিশ করে। এতে পিডিবির প্রতি ইউনিটে বিদ্যুতের দাম ৯৩ পয়সা বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে পিজিসিবি ৫০ দশমিক ৭৭ শতাংশ সঞ্চালন মাশুল বৃদ্ধির যে আবেদন করেছে, সেখানে ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ বৃদ্ধিকে যুক্তিযুক্ত মনে করছে কমিশনের মূল্যায়ন কমিটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১০ বছরে আট বার বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। এ খাতের সিস্টেম লস এবং দুর্নীতি রোধ করতে পারলেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না বরং কমানো যায়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক কিংবা সেবা প্রদানকারী সংস্থা-কোম্পানিগুলো তাতে আগ্রহী না হয়ে সব সময় দামবৃদ্ধির পথে হাঁটতেই পছন্দ করে।
বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা দাম এবং সঞ্চালন মাশুল বাড়াতে কোম্পানিগুলোর আবেদনের ওপর শুনানি গ্রহণ গতকাল শুরু হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত খুচরা এবং পাইকারি উভয় ধরনের বিদ্যুতের মূল্যহার সমন্বয় নিয়ে শুনানি করবে কমিশন। সাধারণত বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য বৃদ্ধির ৬০ শতাংশ পর্যন্ত খুচরা মূল্য বৃদ্ধি হয়ে থাকে। তবে এ বিষয়ে কমিশনই চূড়ান্ত আদেশ দেয়। এক্ষেত্রে সরকার ঘাটতির যে অংশ ভর্তুকি দেয় তার বাইরের অংশ গ্রাহকের কাছ থেকে নিয়ে থাকে কমিশন।
রাজধানীর টিসিবি ভবনের মিলনায়তনে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পিডিবির পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে সংস্থাটি পাইকারি বিদ্যুতের দাম ২৩ দশমিক ২৭ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। পিডিবি তাদের আবেদনে বলছে আগামী বছর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি না করলে তাদের ৮ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা লোকসান হবে। ২০২০ সালে বিদ্যুত বিক্রি করে আয় হতে পারে ৩৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ওই সময়কালে প্রয়োজন হবে ৪৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। সেই হিসেবে প্রতি ইউনিট পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১ দশমিক ১১ টাকা বৃদ্ধির আবেদন করে পিডিবি। কমিশনের কারিগরি কমিটি বলছে, সর্বোচ্চ ইউনিট প্রতি ৯৩ পয়সা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
শুনানিতে পিডিবির পক্ষ থেকে প্রস্তাব উত্থাপন করেন জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) কাউসার আমীর আলী। অন্যদিকে মূল্যায়ন কমিটির পক্ষে সুপারিশ তুলে ধরেন কমিশনের উপপরিচালক (ট্যারিফ) মো. কামরুজ্জামান।
শুনানিতে অংশ নিয়ে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক সামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের মূল্য কী করে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায় সেই চেষ্টা কখনো করা হয় না। এতে করে বারবার মূল্য বৃদ্ধি করতে হয়। নানাভাবে অযৌক্তিক প্রকল্প গ্রহণ এবং ব্যয় বৃদ্ধির জন্য বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পায়।
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, এর আগে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সময় কমিশন বলেছিলো গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু এখন এসে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, অনন্তকাল ধরে দেশে কুইক রেন্টাল চলতে পারে না। কবে নাগাদ রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র বাতিল করা হবে জানতে চাইলে পিডিবি বলে, রেন্টালের চুক্তি শেষ হলে আর নবায়ন হচ্ছে না। এর সময় নির্দিষ্ট করে বলতে না পারায় আলাল বলেন, মানুষ কোমায় থাকলে নির্দিষ্ট করে বলা যায় না কখন কী হবে। এক্ষেত্রে পুরো জাতি কি কোমায় চলে গেছে?
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) স্ট্যান্ডিং কমিটি অন পাওয়ার গ্যাস অ্যান্ড টেলিকমের চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, বিদ্যুত্ খাতের সিস্টেম লস ও অদক্ষতা দূর করা জরুরি। বারবার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি দেশের ব্যাবসায়িক প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। একদিকে মানসম্পন্ন ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ নেই, অন্যদিকে দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধির কারণে শিল্প-কারখানা ভুগছে। তাই মূল্যবৃদ্ধি না করার অনুরোধ জানান তিনি।
সঞ্চালন মাশুল বৃদ্ধির শুনানিতে পিজিসিবি জানায়, আগামী বছর তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে ৫০ দশমিক ৭৭ শতাংশ সঞ্চালন মাশুল বৃদ্ধি করতে হবে। এর বিপরীতে কমিশনের কারিগরি কমিটি বলছে সর্বোচ্চ ইউনিট প্রতি ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ মূল্য সমন্বয় করা যেতে পারে। পিজিসিবি ইউনিট প্রতি শূন্য দশমিক ১৪১৫ টাকা বৃদ্ধির আবেদন করেছে। কিন্তু কমিশন বলছে বাড়ানো হতে পারে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ০১৯৩ টাকা।
শুনানিতে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া প্রস্তাবটি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এককভাবে বিদ্যুত্ সঞ্চালনের ক্ষেত্রে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যয় বাড়ছে।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামসুল আলম বলেন, সম্প্রতি সরকার বেসরকারি বিদ্যুত্ কেন্দ্রের মতো বেসরকারি খাতে সঞ্চালন ব্যবস্থা ছেড়ে দিতে চাচ্ছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি কেন্দ্রের মতোই তাদের জন্যও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট রাখা হচ্ছে। এটা ব্যবসায়ীদের জন্য একটি ভালো ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি পিজিসিবির কাছে জানতে চান—পিজিসিবি সারাদেশে সঞ্চালনের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ না হলে কেন এই উদ্যোগ। তবে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এটি সম্পূর্ণ সরকারের এখতিয়ার।
শুনানিতে কমিশনের চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম, সদস্য মিজানুর রহমান, আব্দুল আজিজ খান, রহমান মুরশেদ, মাহমুদউল হক ভুঁইয়া উপস্থিত ছিলেন। শুনানি চলাকালে টিসিবি ভবনের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে কয়েকটি সংগঠন।