ইচ্ছে শক্তিই সকল বাধা সরানোর হিরন্ময় হাতিয়ার
স্টাফ রিপোর্টার: মাবিয়া খাতুন। একজন যোদ্ধা। দারিদ্র্যসহ সকল প্রতিকূলতাকে হার মানিয়ে গতকাল সোমবার মাবিয়া খাতুনের মাথায় উঠেছে বিজয়ের মুকুট। তিনি হয়েছেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রভাষক।
মাবিয়া খাতুন চুয়াডাঙ্গা শহরতলি দৌলাতদিয়াড় সরদারপাড়ার উত্তরপ্রান্তের বাসিন্দা মো. নিজাম উদ্দীন ও আম্বিায়া বেগমের কনিষ্ঠ কন্যা। যার লেখাপড়াই এক সময় পড়ে হুমকির মুখে। অসম্ভব হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অর্থ যোগানো। সেই মাবিয়া খাতুন এখন বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক। নিজে আলোকিত হয়ে এখন আলোছড়ানোর ব্রত নিয়ে শুরু করলেন কর্মজীবন। যদিও লক্ষ্যপূরণে এখনও বেশ কিছুটা পথ বাকি। তাতে কী, জীবনের চরম অনিশ্চয়তা আর অর্থের তীব্র সঙ্কটসহ আচমকা অনেক বাঁক পেরিয়ে গতকাল যখন মাবিয়া খাতুন মাথাভাঙ্গাকে সু সংবাদ জানিয়ে হাস্যোজ্জ্বল মুখে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটনের কথা; তখন মাঝগগনে চন্দ্রের পাশে যেন অসংখ্য নক্ষত্রও উৎফুল্ল হয়ে স্বাগত জানালো তাকে। হরেক রকম গাছে ঘেরা নির্মল পরিবেশের মাঝে মাথাভাঙ্গা দফতরে গতকাল তখন ছিলো সন্ধ্যা।
মাবিয়া খাতুন একভাই ও দু বোনের মধ্যে ছোট। পিতা নিজাম উদ্দীন একসময় ভালো ব্যবসায়ী ছিলেন। ছাত্রজীবনে তিনি প্রাইভেট টিউশনিও করিয়েছেন। ব্যবসা করতে গিয়ে সরল বিশ্বাস তাকে আচমকা ফেলে দেয় খাদে। সেই থেকেই তিনি মানসিক ভারসাম্য হারানো একজন মানুষ। তার চিকিৎসায় যেমন গেছে শেষ সম্বল তেমনই ছোট ছোট ছেলে মেয়ের মুখে দু বেলা দু মুঠো খাবার জোটাতে স্বল্প বেতনের চাকরি নিতে হয়েছে আম্বিয়া খাতুনকে। এ দম্পতিরই ছোট মেয়ে মাবিয়া খাতুন। ওর বড় ভাইকে পরের দোকানে কাজ করতে হয়েছে। বোনটাকেও পড়াশোনার বদলে বিয়ে দিয়ে সংসারের ভার কমাতে হয়েছে। মাবিয়া ছোট। মেধাবী। কিন্তু তার সামনে বড় বাধা দারিদ্র্য। ২০০৮ সালে এসএসসি পাস করেন। এইচএসসি পাস করেন ২০১০ সালে। এরপর? বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রী ভালো ফল করেও উচ্চ শিক্ষার জন্য তখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে। মাবিয়ার চাচাতো ভাই তছলিম উদ্দীন আর প্রতিবেশী দৈনিক মাথাভাঙ্গা সম্পাদক সরদার আল আমিন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে মাবিয়ার মেধার ধারাবাহিক ঔজ্জ্বল্য পত্রিকায় তুলে ধরে হৃদয়বানের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। সফলতা এলো। তখন রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার মেয়র। তিনি মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় প্রতিবেদন পড়ে হাজির হলেন মাবিয়া খাতুনদের জীর্ণ কুঠিরের আঙিনায়। পাশে দাঁড়ালেন মাবিয়া খাতুনের পাশে। ঢাকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনেস্ট্রেটিভ বিভাগে ভর্তির যোগ্য হলেন। খরচ জোগাতে লাগলেন শিক্ষাপ্রেমী টোটন জোয়ার্দ্দার। অনার্স সম্পন্ন হলো, এমবিএ হলো। গত ১৪ এপ্রিল এমবিএ’র ফল প্রকাশের পরই বিজ্ঞপ্তি পেয়ে মাবিয়া সিভি পাঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাইন্স অ্যান্ড টেকনলজি বিশ্ব বিদ্যালয়ে। সিভি পেয়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য তড়িৎ আহ্বান। পরীক্ষা নিয়েই নিয়োগকর্তারা লেকচারার পদে চাকরিটা করে দেন কনফার্ম। শিক্ষকতা চাকরি তার দীর্ঘ সংগ্রাম জীবনের বিজয়সূচক মুকুট। যদিও মাবিয়ার এখন লক্ষ্য পিএইচডি। দুর্গম পথ মাড়ানো মাবিয়া খাতুনের কাছে এটা এখন নাকে নস্যি দিয়ে ‘হাচ্ছি’ নয় কি?
মাবিয়া খাতুনের এখন স্পষ্ট উক্তি- না, কোনো বাধাই বাধা নয়, নিজের ইচ্ছে শক্তিটাই বড়। নিজের ভেতরে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য যেদিন চাচাতো ভাই তছলিমের নিকট করেছিলাম আকুতি, সেদিন বুঝিনি ইচ্ছে শক্তিই সকল বাধা সরানোর হিরন্ময় হাতিয়ার।