স্টাফ রিপোর্টার: এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাসহ প্রায় সাড়ে ২৮ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় তা দ্রুত দমানোর জন্য সরকার এবার শর্টকাট কৌশলী পথ খুঁজছে। এ নিয়ে দফায় দফায় জরুরি বৈঠকের পর ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ ব্যাপারে বেশকিছু খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেছে। যা পর্যালোচনা করে সরকারের নীতিনির্ধারকরা শিগগিরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল দাবির খুবই সামান্য পূরণ হলেও গোটা আন্দোলন পণ্ড করা যাবে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রশাসনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, এ আন্দোলনে মূলত যাদের সম্পৃক্ত হওয়ার কথা তাদের বাইরে আরও বিপুলসংখ্যক সুবিধাবাদী শিক্ষক এতে যুক্ত হয়েছেন। নির্বাচনের বছরে সরকারকে চাপে রেখে দাবি আদায় করতে হলে বড় আন্দোলন করতে হবে- এমন যুক্তিতে মূল আন্দোলনকারীরাও তাদের সহজে দলে ভেড়ার সুযোগ দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে এবার পাল্টা কৌশলে আন্দোলনকারীদের ঐক্যে ফাটল ধরানোর ছক কষছে সরকার।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাকাল, শিক্ষার্থীর সংখ্যা, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, অবকাঠামো, জমির পরিমাণ, পাঠদানের বিষয়, ক্যাচমেন্ট এরিয়া, সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম এবং প্রতিষ্ঠানের ধরন- যেমন স্কুল হলে বিভাগ বিভাজন এবং কলেজ হলে উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি, অনার্স, মাস্টার্স ইত্যাদি বিষয় বিবেচনার বিষয় রয়েছে। অথচ এখন যেসব স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের জন্য আন্দোলন করছেন এর সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই কোনো মানদণ্ডের যোগ্য নয়। তাই গণহারে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলে অযোগ্যরাও সুবিধাভোগী হবে। এতে যোগ্যরা অবমূল্যায়িত হবে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার নামে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ শিক্ষাবাণিজ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। যা শিক্ষা খাতকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত করে তুলবে। আন্দোলন দমাতে এসব বিষয় এবার কৌশলে সামনে তুলে আনা হবে। একই সঙ্গে সার্বিক মানদণ্ডে যোগ্য বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকার সহসাই জাতীয়করণ করার জোরালো আশ্বাস দেবে। এতে যোগ্য ও অযোগ্যদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হবে। যা শিক্ষকদের তোড়জোড় আন্দোলন পণ্ড করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বিশ্বাসী নয়টি শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মোর্চা আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে নানা কৌশলী ভূমিকা পালন করছে। তারা জাতীয়করণের একদফা দাবিতে বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণ লিয়াজো ফোরামের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচি ডাক দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
শিক্ষকদের অনশন অব্যাহত রাখা অযৌক্তিক দাবি করে এরইমধ্যে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের (স্বাশিপ) সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেছেন, যেহেতু সংসদের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন, সেহেতু আন্দোলনরত শিক্ষকদের অনশন ভেঙে ক্লাসে ফিরে যাওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, জাতীয়করণ বিষয়টি সময়ের প্রয়োজন আছে। বাজেট বরাদ্দ থাকতে হবে। তাই সুপরিকল্পিতভাবে এ আন্দোলন করা উচিত। তিনি ২১ জানুয়ারি দেশের সব উপজেলায় মানববন্ধন, ২৭ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে বৈঠক, ২৮ জানুয়ারি জেলায় জেলায় মানববন্ধন ও ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলনের ডাক দেন। এ অবস্থায় বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনের আলাদা আলাদা কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। পাশাপাশি সংঘবদ্ধ আন্দোলনে বড় ধরনের বিভেদ তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ নব জাতীয়করণকৃত ও বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি এরই মধ্যে চলমান শিক্ষক আন্দোলনের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ একটি চলমান প্রক্রিয়া- এমন দাবি তুলে এ সমিতির নেতারা অভিযোগ করেন, খোদ প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ক্রমে এমপিওভুক্ত ও বাদ পড়া বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও যারা আন্দোলন করছেন তারা স্বার্থান্বেষী। তারা সাধারণ শিক্ষকদের কষ্টের মধ্যে ফেলে অনশনের নামে অরাজকতার পথ বেছে নিয়েছেন। সরকারকে আগে আল্টিমেটাম না দিয়ে সরাসরি অনশন কর্মসূচি পালন করা আইনবিরোধী ও অপরাধ বলেও দাবি করেন এ সমিতির নেতারা।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, আন্দোলন দমাতে শুধু শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ তৈরিই নয় আরও বেশকিছু কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতি রয়েছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও জেলা-উপজেলা থেকে শিক্ষকরা যাতে ঢাকায় এসে আন্দোলনে যোগ দিতে না পারে সে ব্যাপারেও সরকার কৌশলী পথ খুঁজছে। এ বিষয়ে শিগগিরই জেলা প্রশাসকদের সতর্ক করা হবে বলে জানা গেছে।
তবে শিক্ষক আন্দোলন নিয়ে সরকারের ততটা উদ্বিগ্ন নয় জানিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তার ভাষ্য, এমপিওভুক্ত সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বল্প সময়ের মধ্যে জাতীয়করণ করা অসম্ভব, আন্দোলনকারী শিক্ষকরাও তা জানেন। তবু তারা সময়ের (নির্বাচনী বছর) সদ্ব্যবহার করতে মাঠে নেমেছেন। এ আন্দোলন এমনিতে ভুল হয়ে যাবে- মনে করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে রাজপথে সোচ্চার শিক্ষক নেতারা জানান, আন্দোলন নস্যাৎ করার গোপন ষড়যন্ত্র তাদের কাছে আগেই ফাঁস হয়ে গেছে। তাই এ ব্যাপারে তারা যথেষ্ট সতর্ক রয়েছে। কৌশলী কোনো পথে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করা হলে কঠোরভাবে তা প্রতিহত করা হবে বলে দাবি করেন তারা।
অন্যদিকে শিক্ষাবিদদের ধারণা, এ আন্দোলন দ্রুত সামাল দেয়া সরকারের পক্ষে সত্যিকার অর্থেই যথেষ্ট কঠিন হবে। এ ব্যাপারে তারা যুক্তি দেখিয়ে বলেন, সরকার চাইলেই স্বল্প সময়ের মধ্যে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে পারবে না। কেননা এর সঙ্গে বিশাল অংকের অর্থ বরাদ্দের বিষয় রয়েছে। এছাড়া ঢালাওভাবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আত্মীকরণের নীতিমালাও এখনো তৈরি হয়নি।
শিক্ষাবিদদের ভাষ্য, যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করার আগে সরকারের সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা থাকতে হবে, সেই নীতিমালায় বলা থাকবে জাতীয়করণের যোগ্যতা অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করতে হবে। সুনির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলেই জাতীয়করণ করা হবে, যে কেউ দাবি করলেই হবে না।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, এখানে জনগণের অর্থ ব্যয় করার ব্যাপার আছে। যারা সরকার থেকে বেতন-ভাতা পাবেন তাদের অবশ্যই যোগ্যতা অর্জনের পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ঠিক থাকতে হবে, শিক্ষার গুণগত মান থাকতে হবে, মানসম্পন্ন শিক্ষক থাকতে হবে। এ ধরনের পূর্বশর্ত পূরণ করলে তবেই জাতীয়করণ করা যায়। সমস্যা হলো, সরকারের এ ধরনের কোনো নীতিমালা নেই। ফলে এই ধরনের দাবি নিয়ে আন্দোলন হয়।
তিনি আরও বলেন, এর আগেও এমপিওভুক্তিকরণ নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে, এটাও শুধু এই নীতিমালার অভাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা, জাতীয়করণ এবং এমপিওভুক্তিকরণের জন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। এ বিষয়ে মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (মাধ্যমিক-১) সাখায়েত হোসেন বিশ্বাস যায়যায়দিনকে জানান, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও শিক্ষক-কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা-১৯৮৩ নামে একটি বিধিমালা রয়েছে। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকটাই অচল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বিধিমালা সংশোধনের জন্য ২০১৬ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্ত্মাবনা দেয়া হয়। তবে তা এখনো সম্পন্ন হয়নি। এটি হতে আরও বেশকিছু সময় লাগবে বলে ধারণা করেন সাখায়েত হোসেন।
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, স্কুল-কলেজ জাতীয়করণের ক্ষেত্রে নতুন কিছু শর্ত আরোপ করে নীতিমালা সংশোধন করার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সংশোধিত নীতিমালার শর্ত অনুযায়ী জাতীয়করণের জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এসএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৯০ শতাংশ, এইচএসসিতে ৮০ ও স্নাতক পর্যায়ে ৭০ শতাংশ পাসের হার থাকতে হবে। সরকারি স্কুল ও কলেজবিহীন উপজেলা সদরে একটি করে প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের নীতিমালায় এমন শর্ত দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এই নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
নীতিমালার ‘পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও ফলাফল’ অংশের ৬.১ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হলে ‘পাবলিক পরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে ৯০ শতাংশ অংশগ্রহণ করতে হবে।’
ধারা ৬.২-এ বলা হয়েছে, ‘পাবলিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে উত্তীর্ণের ন্যূনতম হার মাধ্যমিক অর্থাৎ এসএসসি পর্যায়ে ৯০ শতাংশ, এইচএসসিতে ৮০ এবং স্নাতক পর্যায়ে ৭০ শতাংশ হতে হবে।’ এছাড়া স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কোন ক্লাসে কতজন শিক্ষার্থী থাকতে হবে, গ্রন্থাগারে কত বই থাকতে হবে ইত্যাদি বিষয়ও উল্লেখ করা হয়েছে তাতে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নীতিমালা সংশোধন করা হচ্ছে। সরকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করতে এ কাজ করছে। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে স্কুল ও কলেজগুলো জাতীয়করণ করতে সহজ হবে।
তবে আন্দোলনকারীরা এ বিষয়টি সরকারের আন্দোলন দমানোর কৌশল বলে অভিযোগ করেছেন। তাদের ভাষ্য, এর আগে সরকার যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছে সেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো মানদ-ই বিবেচনা করা হয়নি। এমনকি একই উপজেলায় যোগ্য প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণেরও বিস্ত্মর নজির রয়েছে। এছাড়া প্রায় দুবছর ধরে নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে। যা প্রকৃতপক্ষে ইচ্ছাকৃতভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।