সুরতোলা বাঁশরিয়া শহরের সবজি ফেরিওয়ালা

চুয়াডাঙ্গা জীবনার কোচরুলের জীবনযুদ্ধের খণ্ডচিত্র

আহসান আলম: ভ্যানে ভর্তি হরেক রকম তরিতরকারি। তারই সিটে বসে আপন মনে বাঁশিতে সুরতোলেন মধ্যবয়সী কোচরুল ইসলাম। জীবন সম্পর্কে বুঝতে না বুঝতেই যাকে পরের বাড়ির গরু চরাতে হয়েছে, সেই বালকই এখন শবজি ফেরিওয়ালা কোচরুল ইসলাম। বাঁশির সুরে সাহাজাদিও ছুটে আসে এরকম কোনো গল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঁশি বাজানো শুরু করে কিনা তা স্পষ্ট করে বোঝা না গেলেও কচরুল কৈশরে শখের বসেই যে বাঁশরিয়া হয়েছে তা তিনি এখনও অকপটেই স্বীকার করেন। কচুরুল ইসলামকে মাঝে মাঝেই চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের আরামপাড়া, গোরস্তানপাড়া, হকপাড়াসহ হাসপাতালপাড়ায় বাঁশির সুর তুলতে শোনা যায়। কে বাজাচ্ছে বাঁশি? রাস্তার দিকে তাকালেই চোখে পড়ে ওই তরকারি ফেরিওয়ালার বাঁশি বাজানো দীর্ঘদিনের চেনা ছবি। ৩ চাকার ছাউনি ছাড়া ভ্যানযোগে শাক-সবজিসহ হরেক পদের তরকারি বিক্রির পেশায় তিনি দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে নিয়োজিত। বাণিজ্যের মাঝেই শখের বসেই তিনি বাঁশিতে সুর তুলেন- মিলন হবে কতো দিনে আমার মনের মানুষের সনে…..। গতকাল সোমবার দুপুরে যখন তিনি হাসপাতাল সড়কের উপজেলা পরিষদ প্রান্তের বাঁকে বসে বাঁশিতে তোলেন সুর, তখন কর্মব্যস্ত মানুষগুলোর মাঝেও যেনো ক্লান্তি মোছার মূর্ছনা পেয়ে মুগ্ধ। শহরের রাস্তায় মাঝে মাঝে বাঁশিতে সুর তোলা মধ্যবয়সী মানুষটা কে? কোথা থেকে আসেন তিনি? এসব প্রশ্ন নিয়ে সবজি ফেরিওয়ালা বাঁশরিয়ার সামনে দাঁড়াতেই তিনি খানেকক্ষণ থেমে থেকে বললেন, ‘ঝিনাইদহ জেলার বংকিরায় পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিলো। দাদা সবা ম-লের সম্পদ-সম্পত্তি কম ছিলো না। বাবা কামাল ম-লের অসুস্থতা আমাদের পথে বসায়। পাশের গ্রাম চুয়াডাঙ্গার জীবনায় ঘরবাঁধি। সেই ছোট বেলাতেই পরের বাড়ি রাখাল হতে হয়। সেই সময়ই আপন মনে গুনগুনিয়ে গান গাওয়া শুরু। তখনই হাতে তুলে নিই বাঁশি। বহু বছর পেরিয়ে গেলো। কত চেনা মানুষ অচেনা হলো। কিন্তু বাঁশিটা সেই ছোটবেলার মতোই আপন হয়ে থেকে গেলো। না, তেমন কোনো ওস্তাদ ধরতে হয়নি, চেষ্টা করেই বাঁশিটাকে বসে নিয়েছি। সবরকম গানেরই সুর এখন বাঁশিতে তুলতে পারি।’
চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের কুতুবপুর ইউনিয়নের জীবনা গ্রামের বাসিন্দা কোচরুল ইসলাম (৫০) বদরগঞ্জ, ডাকবাংলা, সরোজগঞ্জসহ এলাকার হাটবাজার থেকে তরিতরকারি কিনে ভ্যানযোগে জেলা শহরের উদ্দেশে রওনা হন। শহরতলী থেকেই বিক্রি শুরু। শহরের কয়েকটি মহল্লা ঘুরে বেচা-বিক্রির কাজের মাঝে শখের বাঁশি বাঁজিয়ে তিনি নিজেই শুধু ক্লান্তি দূর করেন না, অন্যদেরও একটু অন্যরকম সুরে ভাসান। যদিও সকলে সব সময় কি ওর ওই বাঁশির সুরকে স্বাগত জানায়? মনোকষ্টেভোগা কেউ কেউ বিরক্তি প্রকাশের অবয়বও সামনে মেলে ধরেন। তাতে অবশ্য বাঁশরিয়া কোচরুলের তেমন কিছু আসে যায় না। একটু দূরে গিয়ে আবারও আপন মনে ফুঁ দেন বাঁশির ফুটোয়। ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তিনি বললেন, এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে তার সংসার নিয়ে সুখেই আছে। আর ছেলে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। দোয়া করবেন সকলে। ছেলের জন্য পরিশ্রমী পিতা দোয়া চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে আবারও সুর তুললেন বাঁশিতে। তখন চোখ দুটো সত্যিই টলোমলো। সুখের নাকি দুখের অশ্রু, বোঝা গেলো না কিছুই।

Leave a comment