সম্পাদকীয়
নীরব বিষের নাম আর্সেনিক। বহু এলাকার অসংখ্য মানুষ পানীয় পানির সাথে এই বিষ পানে বাধ্য হচ্ছে। তাদেরই একজন মেহেরপুর আলমপুরের শুকজান বিবি। তিনি আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় শয্যাগত। মৃত্যুর সাথে লড়ছেন। দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় শুকজানের সচিত্র প্রতিবেদনে এলাকায় আর্সেনিকের ভয়াবহতার যে খণ্ডচিত্র উঠে এসেছে তাও ভয়াবহ। এরপরও কি বিষমুক্ত পানীয় পানির জোগান মিলবে?
এক সময় মানুষকে নদী-নালা খাল বিলের পানির ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হয়েছে। কালক্রমে যেমন দূষণ বেড়েছে, তেমনই পানি বিশুদ্ধ করার তাগিদ এসেছে। ভূ-গর্ভের পানি বিশুদ্ধ বলে প্রচার প্রচারণা চালানোর ইতিহাস বেশি দিনের নয়। এতো অল্পদিনেই ভূ-গর্ভের পানি যে মাত্রারিক্ত আর্সেনিকযুক্ত হয়ে মানুষের জন্য প্রাণঘাতীতে রূপ নেবে তা কয়েক যুগ আগেও অতোটা বুঝে ওঠা যায়নি। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরের বহু গ্রামের শতভাগ টিউবওয়েলের পানিই মাত্রারিক্ত আসের্নিকযুক্ত। কোনো কোনো এলাকায় ভূ-গর্ভের পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা এতোটাই বেশি যে, তা পান করে অল্প দিনের মধ্যেই অসহনীয় যন্ত্রণায় কাতরাতে হচ্ছে। কেননা, আর্সেনিক নামক বিষ পানে মানুষ একদিনে মরে না, শরীরের বিভিন্ন অংশে পচন দেখা দেয়। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার বহির্প্রকাশ প্রথমে হাত-পাসহ ত্বকে পরিলক্ষিত হয়। বিষক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় আর্সেনিকমুক্ত বিশুদ্ধ পানি পান। বিষমুক্ত পানীয় পানির জোগান না থাকলে সাধারণ মানুষ পান করবে কী? জেনে শুনেও বহু নারী পুরুষ শিশু-কিশোর এবং আবাল বৃদ্ধ-বণিতাকে পানির নামে বিষপান করতে হচ্ছে। অথচ প্রতিকার মিলছে না। কিছু এলাকায় পানীয় পানির ব্যবস্থা করা হলেও তা খুবই সীমিত।
আর্সেনিকবিষ সম্পর্কে আমজনতাকে সচেতন করা যতোটা না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো বিশুদ্ধ পানীয় পানির জোগান দেয়া। বৃষ্টির পানি আর্সেনিকমুক্ত, কিন্তু তা ধারণ করে পানের উপযোগী রাখার ব্যবস্থা গড়তে তেমন অভ্যস্ত নন চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ জনপদের মানুষ। ভূ-গর্ভের পানিও বিশেষ প্রক্রিয়ায় আসের্নিকমুক্ত করা যায়। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে এলাকার বহু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সে ব্যবস্থা করা হলেও শুরুতেই অনিয়ম, দুর্নীতির পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তার প্রায় সবই অচল হয়ে পড়ে আছে। এক সময় গ্রামবাংলার টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করে তা পানের উপযোগী কিনা সেটা জানানোর জন্য লাল-সবুজ রঙ লাগানো হতো। এখন তা করা হয় না। যেহেতু আর্সেনিকের মাত্রা পর্যায়ক্রমে অতিরিক্ত হচ্ছে, সেহেতু পরীক্ষা নিরীক্ষা কর্মসূচির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা দরকার। সেটা নেই। ফলে পানীয় পানির সাথে বিষের মাত্রা কোন এলাকার মানুষ কতটা বেশি পান করে অকালে অসহনীয় কষ্ট নিয়ে মরতে যাচ্ছে তাও বোঝার জো নেই। এ অবস্থায় কি বলা যায়, জনপদের সকল মানুষ ভালো আছে, নিরাপদে আছে? অবশ্যই পানীয় পানি সহজলভ্য করতে হবে। নদ-নদীর দেশে বিশুদ্ধ পানীয় পানির জন্য হাহাকার অক্ষমতারই অংশ নয় কি?
বিশ্বজুড়েই বিশুদ্ধ পানীয় পানি নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে। বিজ্ঞান এখন ভূ-পরিমণ্ডলের বহু থেকে স্বল্প খরচে বিশুদ্ধ পানীয় পানির জোগান পাওয়ার ব্যবস্থা করছে। বুঝে না বুঝে দিনের পর দিন দূষণের মাত্রা বাড়িয়েই চলেছি অমরা। আমরাই ঝরনার পানিও পানের উপযোগী রাখতে পারেনি। ভূ-গর্ভের পানি? মাত্রারিক্ত আহরণে তাতেও বেড়েছে দূষণ, সেটাও এখন দূষিত। বিজ্ঞান বায়ু থেকে পানি নিলেও তা কতোদিন দূষণমুক্ত থাকবে?
পুনশ্চ: প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে অপচয় রুখতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়া তা করে দেখিয়েছে। তারা ব্যবহৃত পানি চার মিনিটের মধ্যে আবারো স্বাস্থ্যসম্মত পানীয় পানিতে রূপান্তর করে পুনঃপুনঃ ব্যবহার করে।