বিভিন্ন প্রশিক্ষণের নামে বরাদ্দকৃত ১৭ লাখ টাকার অধিকাংশই বেহাত হওয়ায় ঠকছেন প্রকৃতরা
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহে স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান থাকা ব্যক্তিরা হিজড়া তালিকায়, প্রকৃত হিজড়ারা পাচ্ছে না আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রশিক্ষণ বাবদ সরকারি ১৭ লাখ টাকা বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও হিজড়াদের জীবন মানোন্নয়নের জন্য ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বিভিন্ন প্রকারের ট্রেনিং বাবদ ১৭ লাখ টাকা ঝিনাইদহের সমাজ সেবা অধিদফতরের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রশিক্ষণ বাবদ বাজেট বরাদ্দ আসছে। সে মোতাবেক জীবন মানোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকারের ট্রেনিং বাবদ ১৭ লাখ টাকা পাচ্ছে না ঝিনাইদহের প্রকৃত হিজড়ারা।
এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গতকাল রোববার ঝিনাইদহ সদরের কাঞ্চননগরের সিনিয়র হিজড়া নাজমার বাসায় এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে ঝিনাইদহ সদরসহ ৬ উপজেলা থেকে আসা হিজড়ারা অভিযোগ করে বলেন, আমরাই প্রকৃত হিজড়া, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের জীবন মানোন্নয়নের জন্য যে ১৭ লাখ টাকা বাজেট বরাদ্দ করেছেন, আমাদেরকে বাদ দিয়ে কেন যাদের বউ, ছেলে-মেয়ে সংসার আছে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে?
হিজড়াদের মধ্যে ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুরের বর্ষা, ব্যাপারী পাড়ার মনোয়ারা, কাঞ্চননগরের আকাশী, উদয়পুরের কারীশমা, কালীচরনপুরের প্রিয়ংকা, নগরবাথানের খালেদা, লক্ষীপুরের সুমী, বয়ড়াতলার কাজল, খাজুরার স্বপ্না ও সুলতানা, ভুটিয়ারগাতির আনোয়ারা, আদর্শপাড়ার শিউলী ও পায়েলসহ ২৭ জন হিজড়ারা অভিযোগ করে বলেন, ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবদুল মতিন অজ্ঞাত কারণে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্যই হিজড়াদের এই প্রশিক্ষণ থেকে আমাদেরকে বাদ দিয়েছেন।
বন্ধু-বান্ধবের সাথে স্কুলে যাওয়া, স্কুল থেকে বাড়িফিরে বিকেলে তাদের সাথে খেলা সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিলো বর্ষার। বর্ষার বয়স যখন ১২ এরপরই তার মধ্যে চলে আসে পরিবর্তন। পরিবার তা লুকানোর চেষ্টা করে। অবশেষে নিজের লজ্জা ঢাকতে বর্ষা চলে যান হিজড়াদের আস্তানায়।
হিজড়াদের মধ্যে নাজমা ও বর্ষা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘এটা কোনো জীবন হতে পারে না। আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চাই। আমরাও অন্যদের মতো করে বাঁচতে চাই। পরিবারের সাথে থাকতে চাই। পড়ালেখা শিখে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে অংশ নিতে চাই। কিন্তু রাষ্ট্র আমাদের সেই সুযোগ দিলেও রহস্যজনক কারণে আমরা সেই সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আমাদের বাজেট মোতাবেক উক্ত প্রশিক্ষণ শেষে যাতে উপযুক্ত কাজ পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি, এই দাবি আমাদের প্রকৃত হিজড়াদের।
কান্না জড়িত কন্ঠে নাজমা আরও বলেন, আমার বয়স এখন ৬৭ বছর। আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে, আমার ছেলে-মেয়ে, স্বামী সংসার কিছুই নেই এখন আমি কি করবো? আমার বয়স যখন ১৬ বছর আমি হিজড়া হওয়ার কারণে আমার বাসা থেকে বের করে দেয় সেই থেকেই আমি আমার জীবনের সাথে লড়াই করে চলেছি প্রতিটা মুহূর্ত। আমি এ দেশের নাগরিক, সরকার যায় সরকার আসে, ভোটের সময় প্রার্থীরা আমাদের কাছে আসে আমারা তাদেরকে ভোট দিই তারপরে তারা আমাদের আর খোঁজখবর নেন না। সরকারের দেয়া বাজেট থেকেও আমরা এখন বঞ্চিত।
প্রিয়াংকা, বর্ষা, আকাশী অভিযোগ করে সাংবাদিককে বলেন, যাদের বউ-সন্তান সংসার আছে তারা সরকারের দেয়া বাজেটের সুবিধা পাচ্ছে, কিন্তু আমরা প্রকৃত হিজড়া সরকারের উক্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। তারা আরও বলেন, ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়ার মিলন তার দুই মেয়ে, ব্যাপারীপাড়ার আক্তার বিবাহিত, বয়ড়াতলার খঞ্জন তার দুই মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়েটারও বিয়ে হয়েছে, ষাটবাড়িয়ার যাদব তার দুই মেয়ে এক ছেলে আছে, খাজুরার হাসেম তার এক মেয়ে থাকা সত্তেও তারা কিভাবে হিজড়া হয়? এ প্রশ্ন এখন ঝিনাইদহের সচেতন মহলের।
ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন তাদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৫শ’ টাকা নিয়ে তাদেরকে হিজড়ার মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়ে এই সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন প্রকৃত হিজড়ারা। তাছাড়া এই নকল হিজড়ারা প্যান্ট গেঞ্জি পরে শহরের বিভিন্ন স্থানে, রাস্তা ঘাটে ছিনতাই করে ও বিভিন্ন অপকর্মে লিপ্ত থাকে।
সম্প্রতি ঝিনাইদহ শহরের কে.সি কলেজের সামনে থেকে ছিনতাই কালীন ডিবি পুলিশ দুজনকে আটক করে বলে জানা গেছে। আবার গত ৯ মার্চ বৃহস্পতিবার হাট গোপালপুর থেকে দুজন প্যান্ট গেঞ্জি পরা নকল হিজড়া সেজে পলাশ ও মেহেদি উক্ত বাজেটের টাকার ভাগ নেয়ার আশায় ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদফতরে পৌঁছুলে তাদের গ্রামের লোকজন ও নেতা শফিকুল ইসলাম শকুর নেতৃত্বে নকল হিজড়া পলাশ ও মেহেদিকে মারধর করে গ্রামে নিয়ে যায়।
ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবদুল মতিনের সাথে মোবাইলে ০১৯১৩-২৪৫৭৫৭ নাম্বারে বারং বার কথা বলতে চাইলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে সমাজসেবা অধিদফতরে সরাসরি কথা বলতে গেলে অফিসের কম্পিউটার অপারেটর রবিউল ইসলাম তার নিজ মোবাইলে রেজিস্টেশন কর্মকর্তা মমিনুরের সাথে কথা বলে জানান, এ বিষয়ে আব্দুল মতিনের সাথে কথা না বলে মমিন সাহেব কোনো তথ্য দিতে রাজি না।
এ ঘটনায় ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন রাশেদা সুলতানা জানান, আমি নতুন যোগদান করেছি। এ বিষয়ে আমি কিছুই যানি না। ঝিনাইদহ উপজেলা সমাজসেবা অফিসের রেজিস্টেশন কর্মকর্তা মোমিনুর রহমান বলেন, হিজড়াদের অভিযোগ সত্য নয়। তাদের পেছনে আমরা বহুবার ঘুরেছি, বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। কিন্তু তারা প্রশিক্ষণ করবে না এবং উল্টো প্রশিক্ষণ ভু-ুল করার হুমকী দেয়। এখন প্রশিক্ষণ শুরুর মুহুর্তে এই অভিযোগ করা বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য বলে তিনি মনে করেন। অবশেষে জেলা প্রশাসকের একান্ত তত্বাবধানে এই প্রশিক্ষণ করা হচ্ছে।