এলাকাবাসীর মনে আজও নাড়া দেয় গাংনীর ধলা গ্রামের তিন সহোদর হত্যাকা-ের ঘটনা
ধলা থেকে ফিরে মাজেদুল হক মানিক: সেই ২০০৮ সালের ৩১ আগস্ট। সীমান্তের ত্রাস দুখু বাহিনী এদিন রাতে নৃশংসভাবে খুন করে মেহেরপুর গাংনীর সীমান্তবর্তী ধলা গ্রামের তিন সহোদর এমদাদুল হক, উলামিন ও জাহিদুলকে। পূর্ব শত্রতার জের ধরে এ খুনের ঘটনাটি ঘটে। এর পরের বছরে এমদাদুল মেম্বারের স্ত্রী রেনুকা বেগমকে বিয়ে করতে ব্যর্থ হয়ে পাষন্ড দেবর দিপু খুন করে একমাত্র সন্তান ইরান বাদশাহকে। তিন সহোদর হত্যা মামলায় দুখু ও ইরান হত্যা মামলায় আহম্মেদ শরীফ ওরফে দিপুর ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। তবে অনেকের মন থেকে মুছে গেছে হত্যাকান্ডের সেই স্মৃতি। কিন্তু আজো এসব স্মৃতি জগদ্দল পাথরের মতো বুকে চেপে আছেন নিহত তিন সহোদয়ের মা অশিতীপর বৃদ্ধা সোনা ভানু। তিন সন্তান আর নাতির মর্মান্তিক মৃত্যু তাকে পাথর বানিয়েছে। আকড়ে পড়ে আছেন সেই স্মৃতি বিজড়িত বাড়িতে। আর প্রহর গুনছেন খুনিদের ফাঁসি কার্যকরের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে সীমান্তবর্তী মাঠ লাগোয়া বাড়িতে অযতœ আর অবহেলায় আগাছায় ভরে ঢেকে গেছে নিহত ইমদাদুলের বাড়িটি। নিহত তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলের স্ত্রীরা থাকেন অন্যত্র। খুনীদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া দু ছেলে জাহাঙ্গীর ও আলামীন থাকেন মেহেরপুরে। কিন্তু ছেলেদের সেই স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি থেকে যেতে পারেননি মা সোনা ভানু। নিজের হাতেই রান্না বান্না করে সেখানেই পড়ে থাকেন। যে কটা দিন বেঁচে থাকবেন তিনি ওই বাড়িতেই থাকবেন বলে জানান। সেই সাথে খুনীদের ফাঁসি দ্রুত কার্যকরের দাবিও জানান তিনি।
জানা গেছে, ২০০৩ সালে সীমান্তবর্তী খাসমহল রংমহল মাঠে অবৈধ পশু হাট বসানো হয় যার নিয়ন্ত্রন কর্তা ছিলো সাত্তার মাস্টার, এমদাদুল মে¤¦ার, মালেক, সিদ্দিক, জাহিদসহ ১০ জন। এরা টোল আদায় করে দুখুকে বঞ্চিত করতো। এ থেকেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব। অপরদিকে গ্রামের মনিরুল ইসলামের স্ত্রী কাঞ্চন বালাকে জোর পূর্বক বিয়ে করে জাহাঙ্গীর। বিষয়টি মনিরুল ইসলাম দুখুকে জানালে দুখু জাহাঙ্গীরকে অনুরোধ করে কাঞ্চনবালাকে ফেরত দেয়ার জন্য। এতে জাহাঙ্গীর রাগানি¦ত হয়ে দুখুকে জবাই করার জন্য তাড়া করে ভারত সীমান্তে রেখে আসে। এ থেকেই শুরু হয় চরম দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্বের জের ধরে ইমদাদুল মে¤¦ার ও সাত্তার মাস্টার গ্যাংরা দুখুর নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। আত্মগোপন করে দুখু।
প্রতিশোধ নিতে দুখু তার দলে ক্যাডার যোগাড় করতে থাকে। যোগ দেয় ধলা গ্রামের অনেকেই। এক পর্যায়ে ২০০৮ সালের ৩১ আগস্ট রাতে দুখু বাহিনী নৃশংস খুনের মহড়া চালিয়ে খুন করে এমদাদুল মেম্বার, উলামিন ও জাহিদুলকে।
এদিকে নিহত এমদাদুল হকের স্ত্রী রেনুকা বেগমকে বিয়ে করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তার মামাতো দেবর দিপু। কিন্তু বিয়েতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তার একমাত্র ছেলে ইরান বাদশা। পথের কাঁটা সরাতে দিপু খুন করে ইরান বাদশাকে। ঘটনার দিন গ্রামের ফুটবল মাঠে খেলা দেখতে নিয়ে এসে পাটক্ষেতে গলাকেটে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে। সন্তানকে হারিয়ে রেনুকা বেগম থাকেন তার বাবার বাড়িতে। আর উলামিনের স্ত্রী আলেয়া খাতুন কুষ্টিয়ায় বিয়ে করে মেয়ে রুনা লাইলাকে নিয়ে সেই স্বামীর বাড়িতেই থাকেন। জাহিদুলের স্ত্রী একমাত্র সন্তান স্বাধীনকে নিয়ে পড়ে আছেন স্বামীর ভিটেই। এ তিন সহোদরের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন নিহতদের সহোদর জাহাঙ্গির ও আলামিন। পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি থাকা সত্বেও স্বাধীন এখন দীনমজুর।
তিন সহোদর হত্যাকান্ডের মামলায় গত ১৯ মে মেহেরপুর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রধান আসামি মিনহাজ উদ্দীন ওরফে দুখু (দুখু বাহিনী প্রধান) ফাঁসি এবং দুখুর সহযোগী আজিম উদ্দীন ও চেতন আলীর যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দেন। ৩২ জন আসামির মধ্যে বাকিদের বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত। দুখু ও আজিম উদ্দীন ভারতে পলাতক এবং চেতন আলী বর্তমানে সাজা খাটছেন।
অপরদিকে মেহেরপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালত গত ২২ নভেম্বর শিশু ইরান হত্যা মামলার রায় দেন। মামলার একমাত্র আসামি আহম্মেদ শরীফ ওরফে দিপুর ফাঁসির আদেশ দেন বিজ্ঞ আদালত। অবশ্য বেশ কিছুদিন আগে জামিনে মুক্ত হয়ে আত্মগোপন রয়েছে দিপু।
দুখু ভারতে আত্মগোপন করে রয়েছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সেখানে গ্যাং গ্রুপ সৃষ্টি করে সীমান্ত এলাকায় বেশ কয়েকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কয়েক বছর আগে দুখু ভারতে ধাড়া এলাকা থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও পরে জামিন পায়। তার পর থেকেই দুখুর কোনো তৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি। জনমনে এসব খুনের ঘটনা সাময়িক রেখাপাত করলেও এখন অনেকটাই ম্লান। কিন্তু ভুলতে পারেন নি সোনা ভানু। সোনা ভানুর দাবি অনতিবিলম্বে দুখুকে দেশে ফিরিয়ে এনে আর দিপুকে গেফতার করে ফাঁসি কার্যকর করা হোক।