ঢাকা দুই সিটি নির্বাচন : প্রচার শেষ কাল ভোট : উৎসবের পাশাপাশি শঙ্কাও

স্টাফ রিপোর্টার: শেষ হলো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার। টানা ২১ দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় শেষ হয়েছে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচারসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম। এখন অপেক্ষা ভোটগ্রহণের। কাল শনিবার ঢাকার দুই সিটিতে একযোগে অনুষ্ঠিত হবে ভোটগ্রহণ। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ চলবে। এবারই প্রথম ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের সব কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করে ভোট নেয়া হবে। মাঠে নেমেছে বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স। আজ কেন্দ্রে কেন্দ্রে নির্বাচনী মালামাল পাঠানো হবে।
ঢাকার এ দুই সিটি নির্বাচনের প্রচারে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংঘর্ষ হয়নি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা অনেকটা নির্বিঘেœই প্রচার চালিয়েছেন। পাশাপাশি পিছিয়ে ছিলেন না অন্য প্রার্থীরাও। সবমিলিয়ে ভোটার ও প্রার্থীদের মধ্যে উৎসবভাব বিরাজ করছে। অপরদিকে ভোটগ্রহণ ও ফলাফল নিয়ে বিরাজ করছে একরকম শঙ্কাও। কয়েকজন প্রার্থী দুই সিটির রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে এমন শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। আর বৃহস্পতিবার রাতে পোলিং এজেন্ট ও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা চেয়ে নির্বাচন কমিশনে দুটি পৃথক আবেদন করেছেন উত্তর সিটির বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল।
ইসিসূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময়ে ঢাকা উত্তরে ৩৬টি ও দক্ষিণ সিটিতে ৫৭টি ওয়ার্ড ছিলো। এবারের দুই সিটিতে ১৮টি করে ৩৬টি ওয়ার্ড সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এতে বেড়েছে ভোটার ও কেন্দ্র সংখ্যাও। এ নির্বাচনে দুই সিটিতে ২ হাজার ৪৬৮টি কেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন ৫৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৭ ভোটার। সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন ওয়ার্ডগুলোর অনেক জায়গায় যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো নয়। এছাড়া দুই সিটিতে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। সবমিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু তাই নয়, ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নের অনেক উত্তর মিলবে এ নির্বাচনে।
এদিকে বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালন কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ইসিতে এসে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, বিএনপির বহিরাগতরা অস্ত্রসহ ঢাকায় অবস্থান করছে। আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল কমিশনকে জানিয়েছে, ভোটগ্রহণ সামনে রেখে চলছে ধরপাকড়। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) জানিয়েছেন, যে কোনো সময়ের চেয়ে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ আছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ের তথ্য নেই।
২২ ডিসেম্বর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ছিলো ৩১ জানুয়ারি, মনোনয়নপত্র বাছাই ২ জানুয়ারি, প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিলো ৯ জানুয়ারি। ভোটগ্রহণের তারিখ ৩০ জানুয়ারি থাকলেও ওইদিন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতী পূজা থাকায় তা পরিবর্তন করে ১ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করা হয়। ১০ জানুয়ারি প্রচার শুরু হয়ে বৃহস্পতিবার প্রচার শেষ হলো।
দুই রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতরসূত্রে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটিতে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে সবমিলিয়ে ৭৫০ প্রার্থী চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। এর মধ্যে মেয়র পদে ঢাকা উত্তরে ৬ জন ও দক্ষিণ সিটিতে ৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বাকি ৭৩৭ জন কাউন্সিলর ও নারী কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন। মেয়র পদে মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক মহল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন বিএনপির ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। এ সিটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আরও রয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী হাজি সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন। বাকি মেয়র প্রার্থীরা হলেন গণফ্রন্টের আবদুস সামাদ সুজন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. আকতার উজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লা, ইসলামী আন্দোলনের মো. আবদুর রহমান ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) বাহারানে সুলতান বাহার।
অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. আতিকুল ইসলামের সঙ্গে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন বিএনপির তাবিথ আউয়াল। এছাড়াও এ সিটিতে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন কমিউনিস্ট পার্টির ডা. আহাম্মদ সাজেদুল, এনপিপির মো. আনিসুর রহমান দেওয়ান, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) শাহীন খান ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের শেখ মো. ফজলে বারী মাসউদ।
প্রার্থী সংখ্যা: ঢাকা উত্তর সিটিতে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে ৪৭০ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ৩৩৪ জন। বাকি ১৩৬ জনের অনেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছেন আবার যাচাইয়ে অনেকের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। বর্তমানে মেয়র পদে ৬ জন, ৫৪টি সাধারণ ওয়ার্ডের বিপরীতে ২৫১ জন কাউন্সিলর ও ১৮টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৭৭ জন নারী কাউন্সিলর ভোটের মাঠে রয়েছেন।
অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণে চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন ৪১৬ জন। এ সিটিতে ৭ জন মেয়র পদে মনোনয়পত্র দাখিল করেছেন। তারা সবাই চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। তবে কমেছে সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর সংখ্যা। এ সিটিতে ৭৫টি ওয়ার্ডে ৪৬০ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও চূড়ান্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ৩২৭ জন ও সংরক্ষিত ২৫টি ওয়ার্ডে ১০২ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও ভোটের মাঠে রয়েছেন ৮২ জন।
প্রথমবার ইভিএম: ঢাকার দুই সিটিতে প্রথমবার ইভিএমে ভোটগ্রহণ করতে যাচ্ছে ইসি। দুই সিটিতে ভোটগ্রহণের জন্য ২৮ হাজার ৮৬৮টি ইভিএম প্রস্তুত করা হয়েছে। ঢাকা উত্তরে ১৫ হাজার ৬৯২টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৩ হাজার ১৭৬টি মেশিন ভোটে থাকবে। আরও জানা গেছে, ভোটকেন্দ্রে ইভিএমের কারিগরি সহায়তা দিতে সশস্ত্র বাহিনীর ৫ হাজার ১৫ সদস্য মোতায়েন থাকবেন। প্রতিটি কেন্দ্রে দুজন করে সার্জেন্ট বা কর্পোরাল বা ল্যান্স-কর্পোরাল অথবা সৈনিক দায়িত্ব পালন করবে। এছাড়া ৫২ জন জেসিও ও ২৭ জন অফিসারও মাঠে থাকবেন। ইতোমধ্যে দুই সিটির জন্য ৫ হাজার ৫৩৮ জন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য নিয়োগের আদেশ হয়েছে।
ভোটার সংখ্যা: ঢাকা দুই সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতর সূত্রে জানা গেছে, দুই সিটিতে ভোটার সংখ্যা ৫৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২৮ লাখ ৪৩ হাজার ৮ ও নারী ভোটার ২৬ লাখ ২০ হাজার ৪৫৯ জন। সিটি করপোরেশন হিসেবে ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোটার রয়েছেন ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩ জন; যার মধ্যে পুরুষ ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫৬৭ ও নারী ১৪ লাখ ৬০ হাজার ৭০৬ জন। অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোটার সংখ্যা ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন; যার মধ্যে পুরুষ ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪১ ও নারী ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৩ জন।
ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ: ঢাকার দুই সিটিতে ২ হাজার ৪৬৮টি ভোটকেন্দ্র ও ১৪ হাজার ৪৪৫টি ভোটকক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটিতে ১ হাজার ৩১৮টি ভোটকেন্দ্র ও ৭ হাজার ৮৫৭টি ভোটকক্ষ এবং দক্ষিণ সিটিতে ১ হাজার ১৫০টি ভোটকেন্দ্র ও ৬ হাজার ৫৮৮টি ভোটকক্ষ রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটিতে ৬৩৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং দক্ষিণে ৬৪৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব কেন্দ্র অবস্থিত।
একক হিসাবে এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি ১১টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন মিরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। একই সিটির তেজগাঁওয়ের সিভিল এভিয়েশন স্কুল অ্যান্ড কলেজে রয়েছে ১০টি ভোটকেন্দ্র। অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কদমতলীর একে হাই স্কুল কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ৮টি ভোটকেন্দ্র রয়েছে।
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা: ঢাকার দুই সিটিতে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা রয়েছেন ৪৫ হাজার ৮০৩ জন। এর মধ্যে ২ হাজার ৪৬৮ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ১৪ হাজার ৪৩৪ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও ২৮ হাজার ৮৬৮ জন পোলিং কর্মকর্তা রয়েছেন। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটিতে ১ হাজার ৩১৮ প্রিসাইডিং ও ৭ হাজার ৮৫৭ সহকারী প্রিসাইডিং ও ১৫ হাজার ৬৯২ পোলিং কর্মকর্তা ভোটগ্রহণ করবেন। অপরদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১ হাজার ১৫০ প্রিসাইডিং, ৬ হাজার ৫৮৮ সহকারী প্রিসাইডিং ও ১৩ হাজার ১৭৬ পোলিং কর্মকর্তা ভোটগ্রহণ করবেন।