স্টাফ রিপোর্টার: বইয়ের পৃষ্ঠা, বিষয়বস্তু ও দাম তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত লঙ্ঘন করে বেসরকারি প্রকাশকেরা উচ্চমাধ্যমিকের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) পাঠ্যবই প্রকাশ করে চলেছেন। কিন্তু এটা দেখভালের দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) রহস্যজনকভাবে নির্বিকার। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে বইগুলো হয়ে উঠেছে জটিল ও দুর্বোধ্য, বিষয়টি নিয়ে তারা আতঙ্কে ভুগছে। বছরের পর বছর বেসরকারি কিছু প্রকাশক শর্ত লঙ্ঘন করে এ ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিলেও এটা বন্ধে শিক্ষা কর্তৃপক্ষের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। এই সুযোগে ভারী ভারী জটিল বিষয়বস্তু ঢুকে বইগুলো মোটা আর কঠিন হচ্ছে। তবে আয়–উপার্জন বেড়েছে সংশ্লিষ্ট প্রকাশকদের। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকেই। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছেলে-মেয়েদের তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দিতে সরকার ২০১৩ সালে আইসিটি বিষয়টি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে। এটি বাংলা-ইংরেজির মতো আবশ্যকীয় বিষয়। এনসিটিবি নিজে বইটি প্রকাশ করে না, তবে শর্ত সাপেক্ষে বেসরকারি প্রকাশকদের ছাপা ও বাজারজাত করার অনুমোদন দেয়। বাজারে এখন এনসিটিবির অনুমোদনের ছাপ মারা ১৯টি বই চালু আছে। এগুলোর মধ্য থেকেই কলেজগুলো যেকোনো একটি বেছে নেয়। বেসরকারি প্রকাশকেরা শর্ত মেনে নির্ধারিত পৃষ্ঠার পা-ুলিপি জমা দিয়ে অনুমোদন নেন। কিন্তু এরপর কলেবর বাড়িয়ে বই ছাপান। এ প্রবণতা বিশেষত ২০১৬ সাল থেকে শুরু হয়। কোনো কোনো বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ফুলে-ফেঁপে আড়াই গুণের বেশি হয়েছে। ২৩০ থেকে ২৪০ পৃষ্ঠার বইয়ের অনুমোদন নিয়ে ৫১২ থেকে সর্বোচ্চ ৬৯৬ পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করা হয়েছে এবং এসব কপি প্রথম আলোর সংগ্রহে আছে। শর্ত লঙ্ঘন করায় এসব বই কার্যত অনুমোদনহীন হয়ে পড়েছে।
জনপ্রিয় চারটি বইয়ের লেখকেরা বলেছেন, সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রথম পরীক্ষা হয় ২০১৬ সালে। তখন বাজারে অননুমোদিত কিছু বই চালু ছিলো। পরীক্ষায় প্রশ্ন আসে ওই সব বই থেকেই। এরপর বেসরকারি প্রকাশকেরা নিজেদের বইয়ের পৃষ্ঠা, বিষয়বস্তু ও দাম বাড়াতে থাকে। বইগুলো পর্যালোচনা করে একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, কলেবর যত বেড়েছে, বিষয়বস্তু ততো কঠিন হয়েছে। বিশেষত মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার শিক্ষার্থীদের কাছে আইসিটি ভীতিকর বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী প বলে, ‘আমার মা তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক চতুর্থ বর্ষে সার্কিট-সংক্রান্ত যা পড়তেন, সেগুলো আমাদের এখন মানবিকসহ প্রত্যেক বিভাগে বাধ্যতামূলক পড়তে হচ্ছে।’ ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একজন ছাত্রী জানায়, সব বিষয়ে সে আশির ওপরে নম্বর পেলেও দ্বাদশ শ্রেণির প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষায় আইসিটিতে ১৬ পেয়েছে। এর কারণ হিসেবে ছাত্রীটি জানায়, অনেক বড় পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যবিষয়গুলো বেশ জটিল।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ অবশ্য বলেন, সবাইকে জোর করে আইসিটি পড়াতে হবে এটা ঠিক নয়। পাঠ্যক্রম যেন শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও আতঙ্কের কারণ না হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।
এনসিটিবির পদস্থ দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি ২০১৩, ২০১৬ ও ২০১৮ সালে বইগুলোর অনুমোদন ও পুনঃ অনুমোদন দিয়েছে। বাজারে ২০১৯ সালে প্রকাশিত যেসব সংস্করণ আছে, সেগুলোর মধ্যে হাসান বুক হাউসের প্রকাশিত বইটি সবচেয়ে ছোট, ৫১২ পৃষ্ঠা। আর সবচেয়ে মোটা বইটি অক্ষরপত্র প্রকাশনীর, ৬৯৬ পৃষ্ঠা। এগুলো কোনোটিই অনুমোদনের সময় জমা দেয়া পা-ুলিপি নয়।
এনসিটিবির ওই দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রকাশকদের চার কপি করে পা-ুলিপি জমা দিতে হয়। বই মূল্যায়নের জন্য প্যানেল গঠিত হয়। মূল্যায়নকারীরা সন্তুষ্ট হলে এনসিটিবি সাতটি শর্ত সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এগুলোর মধ্যে তিনটি শর্ত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, পাঠ্যপুস্তকে কোনো বিষয়বস্তু ঢোকানো বা বাদ দেয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, বইয়ের আকার, মূল্য ও পৃষ্ঠাসংখ্যা বাড়ানো যাবে না। তৃতীয়ত, তিনটি শিক্ষাবর্ষ পর নতুন করে অনুমোদন নিতে হবে।
কথা ছিলো, যেকোনো একটি শর্ত ভঙ্গ করলে কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়ে এনসিটিবি অনুমোদন বাতিল করবে। কিন্তু প্রতিটি প্রকাশনী অন্তত তিনটি শর্ত ভাঙলেও বোর্ড কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘আমরা লোকবলের অভাবে অনেক সময় ব্যবস্থা নিতে পারি না। এখনই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বলছি।’
২০১৩ সালে অনুমোদিত প্রকাশকেরা শর্ত মেনেই বই ছাপিয়েছিলেন। তারা বর্ধিত সংস্করণের নামে বেশি দামের বড় বই বের করতে শুরু করেন ২০১৬ সাল থেকে। অন্তত চারজন প্রকাশক ও লেখক বলছেন, সে সময় অনুমোদনহীন প্রকাশকেরা বড় কিছু বই বাজারে এনেছিলেন। সরকার সেগুলো বাজেয়াপ্ত করেনি। ২০১৬ সালে ওই সব বই থেকে পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন আসা শুরু হয়। অনুমোদিত প্রকাশকেরাও প্রতারণার পথে হাঁটেন। বাজারে অনুমোদন না থাকা বইও এখনো চলছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেছেন, অনুমোদনহীন প্রকাশকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া এবং নজরদারির দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি)। তবে মাউশির একজন সহকারী পরিচালক বলেন, এনসিটিবি বইগুলোর অনুমোদন বাতিল করে চিঠি দিলে অধিদফতর ব্যবস্থা নিতো। হলি ক্রস কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রীটি শিক্ষকদের কাছে শুনেছে, ভবিষ্যতে ভৌতবিজ্ঞান বা প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনা করলে পাঠ্যসূচির বিষয়গুলো কাজে লাগবে। মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের উপযোগী বিষয়াবলি সেখানে নেই।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের (সিএসই) শিক্ষার্থী আকিবুল ইসলাম বলেন, তিনি কলেজে পড়ার সময়ও একই রকম কথা শুনতেন। এখন বুঝতে পারছেন, তথ্যপ্রযুক্তির প্রাথমিক ধারণা দেয়ার বদলে আইসিটি বইগুলো ছিল দুর্বোধ্য, এগুলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়ানো হয়।
উচ্চমাধ্যমিকের আইসিটি বইগুলোতে মোট ছয়টি অধ্যায় আছে। এগুলো সিএসই বিষয়ে স্নাতক শ্রেণির পাঠ্যসূচির সারাংশ বলা যায়। প্রথম অধ্যায়ে আইসিটির মৌলিক ধারণা দেয়া হয়েছে। পরের পাঁচটি অধ্যায়ে যা আছে, তা সিএসইর স্নাতক পর্যায়ে প্রথম থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত পড়ানো হয়।
ডেটাবেইস ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নিয়ে ষষ্ঠ অধ্যায়ে যে বিশদ আলোচনা আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে তা তৃতীয় বর্ষে পড়ানো হয়। পঞ্চম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু কম্পিউটার প্রোগ্রামিং। এখানেও এমন বিশদ আলোচনা আছে, যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়ানো হয়। চতুর্থ অধ্যায়ে থাকা ওয়েব ডিজাইন পরিচিতি ও এইচটিএমএল বিষয়গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষের পাঠ্য। সংখ্যাপদ্ধতি ও ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ের যে পাঠ্যক্রম, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের পাঠ্য।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার অন্তত ৩০ জন শিক্ষার্থী বলেছেন, বাংলাদেশে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রকৌশল পড়ার সুযোগ নেই। অযথা বিষয়গুলো চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বাড়ানো হচ্ছে। এ প্রতিবেদক অন্তত ২০ জন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলেছেন। মো. মনিরুজ্জামানের ছেলে ঢাকার একটি সরকারি কলেজে পড়ছেন। মনিরুজ্জামান বলেন, এমনিতেই নানা পরীক্ষার কারণে ক্লাস হয় না। এত বড় বই ক্লাসে পড়িয়ে শেষ করা অসম্ভব।
এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, সর্বস্তরে তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের (ডিজিটালাইজেশন) অংশ হিসেবে আইসিটি বিষয়টি উচ্চমাধ্যমিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষাক্রম নির্ধারণ ও উন্নয়নের জন্য এনসিটিবি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে দুটি কমিটি করেছিলো। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতেই ২০১২ সালে বর্তমান শিক্ষাক্রমটি তৈরি হয়।
তবে কমিটির একাধিক সদস্য বলছেন, তাদের সুপারিশ উপেক্ষিত হয়েছে। ছয় সদস্যের শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান সুরাইয়া পারভিন। তিনি বলেন, ‘আমরা যে সুপারিশ করেছি, এনসিটিবি তা পাল্টে দিয়েছে।’
আধা ডজন আইসিটি বই উল্টেপাল্টে দেখে অধ্যাপক সুরাইয়ার মন্তব্য, ‘ভয়াবহ বই! আমরা শুধু প্রাথমিক ধারণা দিতে বলেছিলাম। অনেক কনটেন্ট বিস্তারিত জুড়ে দেয়া হয়েছে, যা আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াই।’
তবে এনসিটিবির প্রকাশিত শিক্ষাক্রমে দেখা যায়, পাঠ্যসূচিটি যথেষ্ট সুনির্দিষ্ট নয়। সেখানে আরও লেখা আছে, পাঠ্যসূচি পরখ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই সদস্যের ভেটিং কমিটি এটা অনুমোদন করেছে। কমিটির সদস্য শাবিপ্রবির সিএসই বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে কয়েকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। অন্য সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের (আইআইটি) ওই সময়ের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ শফিউল আলম খান বলেন, এ বিষয়ে তারা বসেছিলেন বলে মনে পড়ে না।
একাধিক শিক্ষক বলেছেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার উপযোগী করে আইসিটির আলাদা পাঠ্যসূচি ও বই আছে। সেখানে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড বা এক্সেলের মতো বিষয়গুলো শেখানো হয়। তবে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচিটি বিস্তারিত।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটির সহযোগী অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, একাদশ দ্বাদশ প্রেণিতে যেসব বিষয় পড়ানো হচ্ছে, তা স্নাতকের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে পড়তে গিয়ে হিমশিম খায়। এই কঠিন পাঠ্যসূচি উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীদের জোর করে পড়ানোটা দুঃখজনক। তার মতে, পাঠ্যসূচি হওয়া উচিত আগ্রহ জন্মানোর জন্য, নিরুৎসাহিত করার জন্য নয়।