দর্শনা হল্টস্টেশনে কালো বাজারে টিকেট বিক্রিতে যাত্রী ভোগান্তি চরমে

হারুন রাজু/হানিফ মণ্ডল: দর্শনা হল্টস্টেশনে চরম ভোগান্তি পোয়াতে হচ্ছে ট্রেনে যাতায়াতকারী যাত্রী সাধারণকে। বরাদ্দকৃত আসন ইন্টারনেটে কেউ কেউ সংগ্রহ করতে পারলেও সিংহ ভাগই টিকেট কালো বাজারিদের কব্জায় থাকে। কালো বাজারিদের কাছ থেকে দ্বিগুণ বা তারও বেশি মূল্যে টিকেট পাওয়া যায়। উপায়ন্তর না পেয়ে কালো বাজারিদের কাছ থেকেই সংগ্রহ করতে হয় অতিরিক্ত মূল্যে টিকেট। যে কারণে এ ধান্দা বন্ধ করা অনেকটাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাস ছয়েক আগে দর্শনা আইসিপি বিজিবি’র তৎকালীন হাবিলদার শওকত আলী দর্শনা হল্টস্টেশন থেকে টিকেট কালো বাজারি বন্ধের ভূমিকা নিয়েছিলেন। সে সময় শুধু স্টেশনই নয় বরং বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলো কালো বাজারিচক্রের সদস্যরা। হাবিলদার শওকত আলীর বদলির পরপর আগের অবস্থায় পরিণত হয়েছে। যেন এ স্টেশনটি কালো বাজারিদের দখলে রয়েছে। এ চক্রের সদস্যদের পাশাপাশি এ ধান্দায় জড়িত স্টেশনের কর্তবাবুদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী যেন সর্বমহলের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
জানা গেছে, ১৮৬২ সালে বর্তমানে দর্শনা আর্ন্তজাতিক স্টেশন প্রতিষ্ঠা হয়। সে সেময় ঢাকা-কোলকাতা যাত্রীবাহি ট্রেন চলাচলা চালু ছিলো। তৎকালীন বৃটিশ শাসনামলে এ এলাকার মানুষকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রেলপথে যাতায়াতের জন্য ভারতের ভেতর দিয়ে বেনাপোল-যশোর হয়ে খুলনায় প্রবেশ করতে হতো। সে সময় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো রেলপথ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর এ অঞ্চলের মানুষের সাথে খুলনার যোগাযোগ একেবারেই ভেঙে পড়ে। খুলনার সাথে যোগোযোগের লক্ষ্যেই ১৯৫২ সালে নির্মাণ করা হয় দর্শনা হল্ট। দর্শনা হল্ট স্টেশন প্রতিষ্ঠার পর এক সময়ের দর্শনা গোয়ালাচাঁদপুর পরিচিতি পেতে থাকে হল্টচাঁদপুরে। দর্শনা হল্টস্টেশনের বয়স এখন ৬৭ বছর পেরিয়েছে। সরকার এ স্টেশন থেকে প্রতিবছর যে লক্ষ্যমাত্রা বেধে দিয়ে থাকে তা অতিক্রম করে সরকারের খাতায় জমা পড়ছে প্রচুর পরিমাণে রাজস্ব। প্রতিষ্ঠালগ্নে স্টেশনে ২/১ ট্রেন চলাচল করতো। প্রতিষ্ঠাকালে টিনের ছাপড়ায় স্টেশনের কার্যক্রম পরিচালিত হলেও ১৯৬৯ সালের দিকে করা হয় পাকাকরণ। বর্তমানে স্টেশনের প্লাটফার্ম প্রায় আধা কিলো মিটার লম্বা করা হয়েছে। যাত্রীদের বসার জন্য পর্যাপ্ত পরিমান ব্যবস্থা করেছে। সেই সাথে যাত্রী বিশ্রামাগারের জন্য দুটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সম্প্রতি। তবে অফিস ভবনটি সেকেলেরই রয়ে গেছে। কালের আবর্তে পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছুই। বেড়েছে জনসংখ্যা। সেই সাথে বেড়েছে ট্রেনযাত্রী। বাড়েনি আসন সংখ্যা। দর্শনা হল্টস্টেশনে প্রতিদিন ১৬টি যাত্রীবাহী ট্রেন বিরতি হয়। ট্রেনগুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনা-চিলেহাটিগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস আপ-ডাউন দুটো। দর্শনা হল্টস্টেশনে এ ট্রেনের আসন সংখ্যা আপ ৩০ ও ডাউন ৩৮টি। খুলনা-চিলেহাটিগামী রুপসা এক্সপ্রেস দুটি ট্রেন এ স্টেশনের আসন সংখ্যা ৩০টি। খুলনা-ঢাকাগামী চিত্রা এক্সপ্রেস ১টি। যার আসন সংখ্যা ২০টি। ঢাকা-খুলনা-ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ১টি। ডাউন ট্রেনে আসন সংখ্যা ৪৫টি। খুলনা-রাজশাহীগামী সাগরদাড়ি এক্সপ্রেস দুটোতে আসন সংখ্যা ১৭৫টি। আপ ৭৫ ও ডাউনে ১০০টি আসন। খুলনা-রাজশাহীগামী কপোতাক্ষ দুটোতে আসন সংখ্যা ৮০টি। এর মধ্যে ডাউন ২০ ও আপে ৬০টি। এছাড়া লোকাল ট্রেনগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজশাহী-খুলনাগামী গোলায়ালন্দ দুটো, খুলনা-চিলেহাটিগামী রকেট দুটো ও খুলনা-রাজশাহীগামী মহানন্দা দুটো। ২০১৮ সালে দর্শনা হল্টস্টেশনে বিভিন্ন রুটের টিকেট বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ৪৮৫টি। যার মূল্য ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৫৭ হাজার ৩৫৫ টাকা। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সর্বমোট টিকেট বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার ২৭৮টি। যার মূল্য ২ কোটি ৭০ লাখ ৪৩ হাজার ৪৯৯ টাকা। এ স্টেশনে ৫ সদস্যের মধ্যে ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বুকিং সহকারী তুষাউর রহমান। আরও ২জন বুকিং সহকারীর মধ্যে রয়েছেন আব্দুল্লাহ ও রুবাইয়া খাতুন। স্টেশন পোটারের দায়িত্বে মামুন হাসান ও মাইক প্রচারের দায়িত্ব পালন করছেন তাছলিমা খাতুন। দায়িত্বরতদের সাথে আলাপকালে জানা যায় লোকবলের কোনো প্রকার সমস্যা না থাকলেও সমস্যা রয়েছে অফিস ভবনে। মানধাত্তা আমলের ভবনে অফিস পরিচালনায় অনেকটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এ শহরের স্টেশনে আসন সংখ্যা তুলনামূলকভাবে একেবারেই অপ্রতুল। যে কারণে প্রতিদিনই যাত্রীদের ভোগান্তির পাশাপাশি টিকেট বিক্রেতাদের বাড়তি কথা শুনতে হয়।
এদিকে দর্শনা হল্টস্টেশনে দীর্ঘদিন ধরেই টিকেট কালো বাজারিচক্রের ধান্দা অব্যাহত রয়েছে। স্টেশনের কতিপয় কর্মকর্তাদের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে এ টিকেট কালো বাজারি চলছে হরহামেশায়। ইন্টারনেটে কিছু টিকেট বিক্রি হলেও সিংহভাগ টিকেটই থাকে কালো বাজারিচক্রের পকেটে। নির্ধারিত মূল্যের তুলনায় দ্বিগুন বা তার চেয়েও বেশি দামে টিকেট বিক্রি করে প্রচুর অর্থ কামাচ্ছে এ চক্রের সদস্যরা। স্টেশনে ভিআইপি যাত্রীদের জন্য শৌচাগার থাকলেও এখানে ভিআইপি টিকেট বিক্রির অনুমোদন নেই। যে কারণে শৌচাগার তালাবদ্ধ থাকে বছরের পর বছর। সাধারণ যাত্রীদের জন্য কোনো প্রকার শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। সম্প্রতি দর্শনা পৌর কর্তৃপক্ষ স্টেশনে শৌচাগার নির্মাণ করেছেন। যা ইজারার মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। স্টেশনে কোনো প্রকার বাউন্ডারি পাঁচিল না থাকায় সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় যাত্রী সাধারণকে। প্রায়ই ঘটে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা। স্টেশনের ওপর দিয়ে প্রধান সড়ক বয়ে গেলেও এখানে নেই ওভার ব্রিজ। হুইল গেটের ব্যবস্থা থাকলে বেশির ভাগ সময় থাকে অকেজো। এ কারণে প্রায় সময় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়তে হয় পথচলাচলকারীদের। খুলনা থেকে দর্শনায় প্রবেশের সময় কোনো প্রকার নামফলক না থাকায় যাত্রীদের স্থান চিনতে চরম দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে হয়। দর্শনা হল্টস্টেশনের কোনোস্থানেই নেই স্টেশনের নামের সাইনবোর্ড। অথচ দর্শনা হল্টস্টেশন থেকে সরকার প্রতিবছর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত রাজস্ব পাচ্ছে। সরকারের খাতায় প্রতিবছর প্রচুর রাজস্ব জমা পড়ছে। ট্রেনযাত্রীদের নিরাপত্তা ও যাত্রীসেবার মানন্নোয়নের ক্ষেত্রে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মন্তব্য ভুক্তভোগীদের। স্টেশনের ঝুঁকিপূর্ণ অফিস ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এলাকাবাসী দাবী করে বলেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগের অন্যতম স্টেশন দর্শনা হল্ট। এ স্টেশনটি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকারকে আন্তরিক হওয়া উচিত। যাত্রী সেবার মান বৃদ্ধি করা হলেও হয়তো সরকার এখনকার তুলনায় আরও বেশি রাজস্ব পেতে পারে। তাই জনসাধারণের সুবিধা ও সরকারের রাজস্ব আয়ের কথা ভেবে এখনি সকল সমস্যা দূরীকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে রেলওয়ে বিভাগের কর্তাদের।