যুবলীগের শামীম ৭ দেহরক্ষীসহ গ্রেফতার : নগদ টাকা অস্ত্র ও মাদক জব্দ

চাঁদাবাজি অস্ত্রবাজি টেন্ডারবাজি এবং মাদক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ : মায়ের নামে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর নিয়ে প্রশ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের পর এবার গ্রেফতার হলেন সংগঠনটির আরেক প্রভাবশালী নেতা এসএম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম। গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানের নিকেতনে শামীমের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। অভিযানে তার সাত দেহরক্ষীকেও গ্রেফতার করা হয়। এ সময় নগদ এক কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) কাগজপত্র, তার একটি আগ্নেয়াস্ত্র, দেহরক্ষীদের সাতটি শটগান-গুলি এবং কয়েক বোতল বিদেশি মদ জব্দ করা হয়। শামীম টেন্ডারবাজ ও চাঁদাবাজ হিসেবে সবার কাছেই ব্যাপক পরিচিত।
র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতারের পর শামীমকে উত্তরায় র‌্যাব-১ এর কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদের পর মাদক, অস্ত্র ও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হবে। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি এবং মাদক সংশ্লিষ্টতার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে বুধবার ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে অস্ত্র ও মাদকসহ গ্রেফতার করা হয়। শামীম যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক বলে লোকমুখে শোনা গেলেও সংগঠনটির সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী দাবি করেছেন, শামীম যুবলীগের কেউ নন। এছাড়া তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। তবে জেলার সভাপতি আবদুল হাই বলেন, ৭১ সদস্যের কমিটিতে শামীম নামে কেউ নেই। সহসভাপতিসহ যে ছয়টি পদ শূন্য আছে তাতে কোনো নেতার নাম প্রস্তাব করা হয়নি।
র‌্যাবের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, শামীম ও তার দেহরক্ষীরা অস্ত্র প্রদর্শন করে চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করতো। শামীমের কার্যালয় থেকে উদ্ধার হওয়া নগদ টাকা অবৈধ উৎস থেকে এসেছে। টেন্ডারবাজি ও অস্ত্রবাজি করে এসব অর্থ উপার্জন করেছেন। তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও বেশ পুরোনো।
অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি-জামায়াত শাসনামলেও গণপূর্তে এই শামীমই ছিলেন ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি। এক সময়ের যুবদল নেতা ক্ষমতার পরিবর্তনে হয়ে যান যুবলীগ নেতা।
অভিযান শেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, অভিযানে এক কোটি ৮০ লাখ নগদ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার ওপরে এফডিআর (স্থায়ী আমানত) পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তার মায়ের নামে ১৪০ কোটি টাকা ও ২৫ কোটি টাকার এফডিআর তার নামে। নগদ টাকা ছাড়াও তার কার্যালয় থেকে মার্কিন ও সিঙ্গাপুরের ডলার, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে। এগুলোর লাইসেন্সের সত্যতা যাচাই করা হবে। এ ঘটনায় শামীমসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিপুল পরিমাণ অর্থ, মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের পরও শামীম ছাড়া পেতে পারেন কিনা জানতে চাইলে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, যদি তিনি নির্দোষ হন, তাহলে আদালতে এগুলোর ব্যাখ্যা দেবেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আদালতে তার বক্তব্য সঠিক হলে তিনি ছাড়া পাবেন। নগদ টাকার উৎস সম্পর্কে সারোয়ার আলম বলেন, র‌্যাবের কাছে তথ্য রয়েছে, নগদ টাকা অবৈধ উৎস থেকে এসেছে। এর সত্য-মিথ্যা প্রমাণ করার দায়িত্ব তার (শামীমের)। এটা তিনি আদালতে প্রমাণ করবেন। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে বৈধ অস্ত্র অবৈধ কাজে ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বৈধ অস্ত্র ব্যবহারের কিছু শর্তাবলী রয়েছে। এগুলো তিনি ভঙ্গ করেছেন।
র‌্যাব জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা জানতে পারেন, জি কে শামীমের নিকেতনের ডি ব্লকের ৫ নম্বর রোডের ১৪৪ নম্বর বাসায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থ, অস্ত্র এবং মাদক রয়েছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে বেলা ১১টার দিকে ওই বাসা ঘিরে ফেলে র‌্যাব। এর আগে নিকেতন এলাকায় জি কে শামীমের আরেকটি বাসা থেকে তাকে ডেকে আনা হয়। পরে তাকে আটক করেই অভিযান চালায় র‌্যাব। নগদ টাকা, অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারের পর তাকে গ্রেফতার করা হয়।
১৪০ কোটি টাকার এফডিআর: শামীমের মায়ের নামে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর রয়েছে। এই এফডিআর’র কাগজপত্র শামীমের কার্যালয় থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তার মায়ের বড় কোনো ব্যবসা না থাকলেও বিপুল পরিমাণ টাকা তিনি পেলেন কোথায় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। এ বিষয়ে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, শামীমের মায়ের নামে ১৪০ কোটি টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে। তার মা বড় কোনো ব্যবসায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। তবে ২৫ কোটি টাকার এফডিআর তার (শামীম) নামে। এসব টাকার উৎস কী এ বিষয়ে অনুসন্ধান করা হবে।
সরেজমিন শামীমের কার্যালয়: বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে নিকেতনে শামীমের ব্যবসায়িক কার্যালয়ে ঢুকে প্রথমেই দেখা যায় বিশাল গ্যারেজ। গ্যারেজের পাশে কাচ দিয়ে ঘেরা একটি অফিস কক্ষ, এখানে কর্মচারী ও কর্মকর্তারা বসেন। ওই ঘরের পাশে দুটি দামি মোটরসাইকেল রাখা রয়েছে। কক্ষের পাশে দুই পাল্লার একটি কাঠের দরজা। দরজার দামি কাঠের চৌকাঠ চোখে পড়ার মতো। দরজা দিয়ে ঢুকতেই ভেতরে তিনতলায় যাওয়ার সিঁড়ি। মার্বেল টাইলসের সিঁড়িটিতে রয়েছে নকশা করা কাঠের রেলিং। চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে সিঁড়িটি। পুরো বাসাটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তৃতীয়তলায় শামীমের বসার কক্ষ। প্রায় ৩০ ফুট লম্বা ও ২০ চওড়া কক্ষটি। পুরো কক্ষটিতে দামি বাতি, কাঠ দিয়ে সাজানো। বড় আকারের দুটি টিভি রয়েছে ঘরে। তিন সেট সোফা ও একটি বড় টেবিল রয়েছে। ওই টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে টাকার বান্ডিল, মদের বেশ কয়েকটি বোতল ও অস্ত্র। এগুলো ওই কক্ষ থেকে পাওয়া গেছে। ওই কক্ষের পাশেই আছে শামীমের ব্যক্তিগত কক্ষ।
মাসুদ নামে শামীমের এক বলেন, র‌্যাব হেডকোয়ার্টার, সচিবালয়ের অর্থভবন, ক্যাবিনেট ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনার কাজ করাচ্ছেন শামীম। এসব স্থানে তার ৫-৬ হাজার শ্রমিক রয়েছে। এদের মজুরির টাকা দেয়ার জন্য বৃহস্পতিবার শামীম টাকা তুলে রেখেছেন। মাসুদ বলেন, এ অফিসে কোনো নারী স্টাফ রাখেননি শামীম। এছাড়া কোনোদিন মদের বোতল তার চোখে পড়েনি।
সরেজমিন আরও দেখা গেছে, শামীমের কার্যালয়ে অন্তত ১৩টি সম্মাননা-পদক রয়েছে। ‘ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংগঠন এবং সমাজসেবায় অবদান রাখায়’ বিভিন্ন সময় তাকে এ সম্মাননা-পদক দিয়েছে নানা সংগঠন। তার পাওয়া পুরস্কারের তালিকায় রয়েছে- ফিদেল কাস্ত্রো অ্যাওয়ার্ড ২০১৭, মাদার তেরেসা গোল্ড মেডেল-২০১৭, অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল-২০১৭, মহাত্মা গান্ধী পিস অ্যাওয়ার্ড-২০১৭, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক-২০১৮ প্রভৃতি।
‘আমাকে বেইজ্জতি কইরেন না’: শুক্রবার দুপুরে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দোতলার একটি কক্ষে শামীমকে বসিয়ে রাখা হয়েছিলো। এক পর্যায়ে র‌্যাবের অনুমতি পেয়ে ভেতরে ঢুকতে থাকেন গণমাধ্যমকর্মীরা। গণমাধ্যমকর্মী আর ক্যামেরার চোখ দেখে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যান শামীম। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘আপনাদের কাছে আল্লাহর ওয়াস্তে বলতে চাই, আপনারা আমার ছবি তুলবেন না। আমি একজন ব্যবসায়ী এবং নেতা। আমার একটা মানসম্মান আছে। আমাকে বেইজ্জতি কইরেন না। এখানে যা হচ্ছে, আপনারা দেখছেন। কিন্তু আমাকেও আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দিতে হবে।’
শামীম আরও বলেন, ‘প্লিজ, আপনারা ছবি তুলবেন না। এ সময় শামীম বারবার নিজেকে লুকোনোর চেষ্টা করছিলেন। কখনও দাঁড়িয়ে, চেয়ারে বসে, হাত দিয়ে মুখ ঢাকছিলেন শামীম। আবার এটা-ওটা খোঁজার জন্য দীর্ঘক্ষণ টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়েও রাখেন।’
এ সময় র‌্যাব কর্মকর্তারা শামীমকে বলেন, আপনি আমাদের সহযোগিতা করেন। আমাদের সহযোগিতার জন্য ও অভিযানের স্বচ্ছতার জন্য মিডিয়া আমাদের সহযোগিতা করছে।
প্রসঙ্গত, ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কয়েকজন নেতার অপকর্মের বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠকেই পদ হারান ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। এরপর বুধবার রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে গ্রেফতার হন যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভুইয়া। ওই দিনই মতিঝিলের ইয়ংম্যান্স ক্লাবের ক্যাসিনোসহ চারটি ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালিয়ে ১৮২ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। ইয়ংম্যান্স ক্লাবের সভাপতি হলেন খালেদ। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগে যুবলীগ নেতা জি কে শামীমকে গ্রেফতার করা হয়। একই দিন ক্যাসিনো পরিচালনার সন্দেহে কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ক্লাব, ধানমন্ডি ক্লাব, অ্যাজাক্স ক্লাব ও কারওয়ান বাজার মৎস্যজীবী ক্লাবে অভিযান চালায় র‌্যাব। অভিযানে কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।